প্রতীকী ছবি।
শব্দ বিধি কার্যকর করা দূর, শহরে শব্দদূষণ রোধে খোদ পুলিশ কমিশনারের নির্দেশ মানেনি তাঁর বাহিনীই— এই অভিযোগ তুলে জাতীয় পরিবেশ আদালতের দ্বারস্থ হচ্ছেন পরিবেশকর্মীরা। তাঁদের বক্তব্য, এটা ভবিষ্যতে সামগ্রিক আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির ক্ষেত্রে এক অশনি সঙ্কেত। ইতিমধ্যেই এক পরিবেশকর্মী বিষয়টি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে পুলিশ কমিশনারকে চিঠি দিয়েছেন।
এ বার উৎসবের মরসুমে, বিশেষত কালীপুজো ও জগদ্ধাত্রী পুজোয় রাত ১০টার পরেও তারস্বরে সাউন্ড বক্স বাজিয়ে অবাধে জলসা হয়েছে পুলিশের সামনে। অনেক ক্ষেত্রেই পুলিশ বলেছে, ‘ওটা দেখা তাদের কাজ নয়। তাদের মোতায়েন করা হয়েছে জলসা ঘিরে যাতে আইনশৃঙ্খলার অবনতি না হয়, সেটা দেখতে।’ কোথাও গভীর রাত পর্যন্ত তল্লাট কাঁপিয়ে মাইক বাজলেও ব্যবস্থা না নেওয়ার পক্ষে স্থানীয় থানার যুক্তি, ‘কই, কেউ তো অভিযোগ করেননি!’
পুলিশ কমিশনার রাজীব কুমার কিন্তু লিখিত নির্দেশ জারি করে জানিয়েছিলেন, রাত ১০টা থেকে পরের দিন সকাল ৭টা পর্যন্ত মাইক বা সাউন্ড বক্স চালাতে দেওয়া হবে না। এমনকী, মাইকে সাউন্ড লিমিটার বা শব্দ নিয়ন্ত্রক লাগানো থাকবে এবং একটানা না বাজিয়ে বিরতি দিতে হবে। নিয়ম না মানলে এবং পুলিশের অনুমতি ছাড়া মাইক বাজালে আইনি ব্যবস্থা নেওয়ারও নির্দেশ দিয়েছিলেন সিপি। তিনি জানান, মাইক বাজানোর ক্ষেত্রে নিয়ম ভাঙলে সেই সব সরঞ্জাম পুলিশ বাজেয়াপ্ত করবে।
অভিযোগ, বাস্তবে কিছুই হয়নি। কখনও স্থানীয় থানা জানিয়েছে, মাইক বা সাউন্ড বক্স বাজেয়াপ্ত করতে গেলে আইনশৃঙ্খলার অবনতি হবে। সাউন্ড লিমিটার কার্যত কোথাও ব্যবহার হয়নি। অথচ পশ্চিমবঙ্গ দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদ এ বার উৎসবের মরসুমে কলকাতা পুলিশকে দেড়শোটি সাউন্ড লিমিটার দিয়েছিল।
পর্ষদের অবসরপ্রাপ্ত মুখ্য আইন আধিকারিক, বর্তমানে পরিবেশকর্মী বিশ্বজিৎ মুখোপাধ্যায় ১৩ নভেম্বর সিপি-কে চিঠি দিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। তাঁর বক্তব্য, মাইক বা সাউন্ড বক্স ব্যবহারের ক্ষেত্রে প্রথমে কলকাতা হাইকোর্ট ও পরে সুপ্রিম কোর্ট নিয়ম বেঁধে দেয়। ২০০০ সালে এ ব্যাপারে বিধি তৈরি হয় এবং সেটা কার্যকর করার ক্ষমতা পুলিশকে দেওয়া হয়েছে। বিশ্বজিৎবাবু বলেন, ‘‘খোদ সিপি-র নির্দেশ থানা স্তরের পুলিশরা অমান্য করছেন। এতে সমাজে ভুল বার্তা যাচ্ছে। ভবিষ্যতে অন্য ক্ষেত্রেও আইনের শাসন ভেঙে পড়তে পারে।’’ বিশ্বজিৎবাবু জানান, বিষয়টি তিনি জাতীয় পরিবেশ আদালতের গোচরে আনবেন।
আর এক পরিবেশকর্মী সুভাষ দত্তের প্রশ্ন, ‘‘শব্দদূষণ রোধে সিপি-র নির্দেশ কি তার মানে শুধুই নাম-কা-ওয়াস্তে?’’ মাইক, সাউন্ড বক্সজনিত শব্দদূষণের অত্যাচার থেকে নিষ্কৃতি চেয়ে সুভাষবাবুর রুজু করা মামলা পরিবেশ আদালতে চলছে। পরবর্তী শুনানি ১৫ ডিসেম্বর। ওই মামলায় ৮ নভেম্বর আদালত নির্দেশ দিয়েছে, রাজ্যের প্রতিটি থানা যেন সাউন্ড লিমিটার, সাউন্ড মনিটর পায়।
সুভাষবাবুর বক্তব্য, ‘‘পুলিশ একটা শৃঙ্খলাবদ্ধ বাহিনী। সিপি-র নির্দেশ তাই পাঁচটা সরকারি দফতরের নির্দেশের মতো নয়। শব্দদূষণ রোধে তাঁর নির্দেশ কার্যকর না করলে পুলিশ কী করে আইনশৃঙ্খলা বজায় রাখবে, কী ভাবেই বা নাগরিক-নিরাপত্তা দেবে?’’ তিনি আরও বলেন, ‘‘আমি আবেদন করব, যাতে সিপি পরিবেশ আদালতে নিজে থেকে ব্যাখ্যা দেন, কেন তাঁর নির্দেশ কার্যকর হল না এবং সে জন্য তিনি কী ব্যবস্থা নিয়েছেন।’’
লালবাজারের একাধিক কর্তা জানাচ্ছেন, বেশির ভাগ ক্ষেত্রে জলসার আয়োজকেরা রাজনৈতিক নেতা-নেত্রীর আশীর্বাদধন্য, কখনও কখনও নেতা-নেত্রীরাই আয়োজক। আবার কিছু কিছু ক্ষেত্রে স্থানীয় থানার পুলিশের সঙ্গে বোঝাপড়া থাকে জলসার আয়োজকদের।