আরও কি গরিব হল শহর? বিপিএলের খসড়া তালিকায় শুরু জল্পনা

চার পাশ যতই ঝাঁ চকচকে বহুতল, শপিং মলে ভরে উঠুক, আদতে কি আরও গরিব হচ্ছে এ শহর? কলকাতা পুরসভার বিপিএলের সর্বশেষ খসড়া তালিকা দেখার পরে অন্তত তেমনই জল্পনা শুরু হয়েছে।

Advertisement

দেবাশিস ঘড়াই

শেষ আপডেট: ২৯ জানুয়ারি ২০১৯ ০০:০৭
Share:

দৈন্য: দারিদ্রসীমার নীচে বসবাসকারী মানুষের সংখ্যা বাড়ছে শহর জুড়ে। ছবি: সুমন বল্লভ

চার পাশ যতই ঝাঁ চকচকে বহুতল, শপিং মলে ভরে উঠুক, আদতে কি আরও গরিব হচ্ছে এ শহর? কলকাতা পুরসভার বিপিএলের সর্বশেষ খসড়া তালিকা দেখার পরে অন্তত তেমনই জল্পনা শুরু হয়েছে।

Advertisement

পুরসভা সূত্রের খবর, ২০১৪-’১৫ সালে শহরে দারিদ্রসীমার নীচে থাকা পরিবারের সংখ্যা যেখানে ছিল ২ লক্ষ ৮৯ হাজার ১৩২, সেখানে ২০১৫-’১৬ সালে ওই তালিকায় আরও প্রায় ১৮ হাজার পরিবার যোগ হয়েছে। ফলে বিপিএল তালিকাভুক্ত পরিবারের সংখ্যা ছাড়িয়ে গিয়েছে তিন লক্ষ।

অর্থনীতিবিদদের একাংশের মতে, শুধু কলকাতা বলে নয়, এক বছরের মধ্যে বিপিএল তালিকাভুক্ত পরিবারের সংখ্যা ১৮ হাজার বৃদ্ধি পেলে তা সংশ্লিষ্ট কোনও শহরের অর্থনীতির ক্ষেত্রেই খুব সুখপ্রদ নয়। যদি প্রতিটি পরিবারের সদস্য সংখ্যা গড়ে তিন ধরা হয়, তা হলেও দেখা যাচ্ছে অন্তত ৫৪ হাজার মানুষ নতুন ভাবে দারিদ্রসীমাভুক্ত হয়েছেন। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির শিক্ষিকা অরিজিতা দত্ত বলেন, ‘‘এক বছরের মধ্যে দারিদ্রসীমার নীচে ৫৪ হাজার মানুষের নতুন ভাবে অন্তর্ভুক্ত হওয়া কোনও শহরের ক্ষেত্রেই খুব আশাপ্রদ নয়। তবে কী কারণে এই অন্তর্ভুক্তি ঘটল, তা-ও দেখতে হবে।’’ অর্থনীতির আর এক শিক্ষক পঞ্চানন দাস বলেন, ‘‘বিপিএল পরিবারের সংখ্যা বাড়া মানেই শহরে গরিবের সংখ্যা বেড়ে যাওয়া। যা শহরের অর্থনীতির ক্ষেত্রে যথেষ্ট উদ্বেগের।’’

Advertisement

২০১০ সাল থেকে প্রতি বছর বিপিএল তালিকা প্রকাশ করে এসেছে পুরসভা। শেষ বার এই পূর্ণাঙ্গ তালিকা প্রকাশ হয় ২০১৪-’১৫ সালে। পরের বছর (২০১৫-’১৬) বিপিএল তালিকার কাজ হলেও সেটি প্রকাশ করা হয়নি। শেষ পর্যন্ত পরিমার্জন ও সংশোধন করে ওই বছরের একটি খসড়া তালিকা প্রকাশ করার সিদ্ধান্ত নেয় পুর প্রশাসন। সেই তালিকা সম্প্রতি বরো চেয়ারম্যানদের কাছে পাঠানো হয়েছে। তাতেই দেখা যাচ্ছে, ১৮ হাজার ৮৮৭টি নতুন পরিবার যুক্ত হয়েছে। অর্থাৎ, বিপিএল তালিকাভুক্ত মোট পরিবারের সংখ্যা বর্তমানে ৩ লক্ষ ৮ হাজার ১৯।

যদিও এই সংখ্যা বৃদ্ধি নিয়ে পুর কর্তৃপক্ষের যুক্তি, বিপিএল তালিকার পরিমার্জন, স‌ংশোধনের কাজ ধারাবাহিক। ফলে তালিকায় পরিবারের সংখ্যা বাড়ার সঙ্গে শহরের অর্থনীতিকে গুলিয়ে ফেলা ঠিক হবে না। যাঁদের নাম এত দিন কোনও কারণে বিপিএল তালিকাভুক্ত করা হয়নি, তাঁদের নাম তোলা হয়েছে। ফলে সরকারি পরিষেবার আওতায় আরও অনেককে আনা সম্ভব হচ্ছে, যাঁরা এত দিন ব্রাত্য ছিলেন।

প্রসঙ্গত, ২০১১-’১২ সালে রঙ্গরাজন কমিটির সুপারিশ অনুসারে দারিদ্র্যসীমার মাপকাঠি উল্লেখ করে দিয়েছিল তৎকালীন প্ল্যানিং কমিশন। যা সর্বশেষ সরকারি হিসেব। সেই মাপকাঠি অনুযায়ী পশ্চিমবঙ্গের শহরাঞ্চলের ক্ষেত্রে মাথাপিছু মাসিক ৯৮১ টাকা বা তার কম আয় হলে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিকে বিপিএল তালিকাভুক্ত ধরার কথা, অর্থাৎ দৈনিক আয় হল ৩৩ টাকা। আবার গ্রামাঞ্চলের ক্ষেত্রে ওই আয় হল মাথাপিছু প্রতি মাসে ৭৮৩ টাকা, দৈনিক ২৬ টাকা। সারা দেশের শহরাঞ্চলের ক্ষেত্রে ওই রেখার মাপকাঠি আবার মাথাপিছু প্রতি মাসে ১০০০ টাকা এবং গ্রামাঞ্চলে ৮১৬ টাকা।

পঞ্চানননবাবু বলেন, ‘‘আন্তর্জাতিক দারিদ্র্যরেখার মাপকাঠি দিনপিছু ১ ডলার বা প্রায় ৭১ টাকা। যদি ওই মাপকাঠি ধরা হত, তা হলে তো গরিবের সংখ্যা আরও বৃদ্ধি পেত শহরে!’’ দু’নম্বর বরোর চেয়ারম্যান সাধন সাহা বলেন, ‘‘২০১৫ সালে বিপিএল ফর্ম দেওয়া হয়েছিল। অথচ তা প্রকাশ হয়নি বলে তালিকায় যোগ হয়নি। এখন সেটা যোগ হয়েছে।

তাই স্বাভাবিক ভাবেই সংখ্যা বাড়বে।’’ ছ’নম্বর বরোর চেয়ারপার্সন সঞ্চিতা মণ্ডল বলেন, ‘‘সংযোজন, সংশোধন তো ধারাবাহিক প্রক্রিয়া। ফলে সংখ্যা বৃদ্ধির বিষয়টি এখনই কিছু বলা যাবে না।’’

যদিও পুর-নথিই জানাচ্ছে, বিপিএল তালিকায় যাঁদের থাকার কথা নয়, তাঁদের নাম বাদ দেওয়া হয়েছে। যাঁরা দারিদ্রসীমার নীচে থাকার সুযোগ-সুবিধা নিতে আগ্রহী নন, বাদ দেওয়া হয়েছে সেই নামও। আবার যাঁরা এপিএল-এ চলে গিয়েছেন, তাঁদের নামও বাদ গিয়েছে। ফলে এত কারণে যদি নাম বাদ যায়, তা হলে স্বাভাবিক ভাবেই বিপিএল তালিকাভুক্ত পরিবারের সংখ্যা কম হওয়ার কথা। কিন্তু তেমনটা বাস্তবে হয়নি। এক আধিকারিকের কথায়, ‘‘সবই যদি বাদ যায় বা দারিদ্রসীমার উপরে চলে যায়, তা হলে তো সংখ্যা কমার কথা। তেমনটা তো হয়নি।’’ এটা ঘিরেই শুরু হয়েছে বিতর্ক।

এমনিতে বিপিএল তালিকা নিয়ে শুরু থেকেই বিতর্ক রয়েছে। অভিযোগ, যাঁদের নাম তালিকায় থাকার কথা তাঁদের পরিবর্তে আর্থিক ভাবে স্বচ্ছল মানুষজনও সরকারি সুবিধা পাওয়ার জন্য ‘কারচুপি’ করে তালিকায় নাম নথিভুক্ত করছেন। ফলে যোগ্যরা থেকে যাচ্ছেন তালিকার বাইরে। সে কারণে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়, প্রতি বছর এই তালিকা সংশোধন করা হবে। ১৬ নম্বর বরোর চেয়ারম্যান ইন্দ্রজিৎ ভট্টাচার্য বলেন, ‘‘আগামী মাস থেকে আবার বিপিএল তালিকার কাজ শুরু হওয়ার কথা। পুরসভা ও কাউন্সিলর সকলে খতিয়ে দেখেই কাজটা করবেন।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন