অযত্নে-অবহেলায় শহরে শ্রীহীন সবুজ

হেদুয়া পার্ক। উত্তর কলকাতার অন্যতম পুরনো এই পার্কে ঢুকে দেখা গেল, চারপাশে ধুলো আর জঞ্জালের স্তূপ। তার মধ্যেই এক দিকে চলছে ফুটবল খেলা, আর এক দিকে বাঁধানো একটি জায়গায় বসে তাস খেলছেন কয়েক জন প্রবীণ। যেখানে-সেখানে ছড়িয়ে চিপ্‌স আর খাবারের প্যাকেট।

Advertisement

তানিয়া বন্দ্যোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ২৯ ডিসেম্বর ২০১৫ ০২:১৪
Share:

হেদুয়া পার্ক

হেদুয়া পার্ক। উত্তর কলকাতার অন্যতম পুরনো এই পার্কে ঢুকে দেখা গেল, চারপাশে ধুলো আর জঞ্জালের স্তূপ। তার মধ্যেই এক দিকে চলছে ফুটবল খেলা, আর এক দিকে বাঁধানো একটি জায়গায় বসে তাস খেলছেন কয়েক জন প্রবীণ। যেখানে-সেখানে ছড়িয়ে চিপ্‌স আর খাবারের প্যাকেট।

Advertisement

লেডিজ পার্ক। এক দিকে চলছে ক্রিকেট ম্যাচ। আর এক দিকে গরু চরাচ্ছেন এক যুবক। পার্কের এক পাশ ভর্তি ভাঙা ইটের টুকরোয়। মূল পার্কটির গা ঘেঁষে রয়েছে শিশু উদ্যান। বিকেলে সেখানে কচিকাঁচাদের ভিড়। দোলনা থেকে স্লিপ— রয়েছে সবই। কিন্তু সবগুলিতেই মরচে পড়া। যে কোনও সময়েই সেগুলি ভেঙে পড়ার আশঙ্কা রয়েছে। রয়েছে একটি অসম্পূর্ণ ফোয়ারাও। এমনকী, কয়েকটি ভাঙা ডাস্টবিনও রয়ে গিয়েছে পার্কে।

যতীন দাস পার্ক। পুরো পার্ক জুড়ে প্লাস্টিক আর খাবারের প্যাকেট ছড়ানো। বসার জায়গাগুলিতেও ধুলো আর নোংরার আস্তরণ। নেই কোনও নিরাপত্তারক্ষীও। ফলে, পার্কে কে কখন ঢুকছেন বা বেরোচ্ছেন, তা কারও নজরে থাকে না। পার্কের পাঁচিলও প্রায় ভেঙে পড়েছে।

Advertisement

রবীন্দ্র সরোবর। পার্কে ঢোকার গেটের মুখে বড় বড় করে লেখা ‘পার্ক পরিষ্কার রাখুন’। কিন্তু ভিতরে সম্পূর্ণ উল্টো ছবি। ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে এঁটো প্যাকেট, খবরের কাগজ, ছেঁড়া প্লাস্টিকের প্যাকেট। লেকে ভাসছে পচা ফুল-পাতা, পোড়া সিগারেটের টুকরো। পার্কের এক দিকে আবার ভাঙা ইটের স্তূপ।


লেডিজ পার্ক

সাফারি পার্ক। পার্কের সামনে ফলাও করে লেখা ‘প্লাস্টিক মুক্ত অঞ্চল’। কিন্তু সেখানেও যত্রতত্র প্লাস্টিকের প্যাকেট ছড়ানো। উপরন্তু পর্যাপ্ত আলো না থাকায় সন্ধ্যা নামতেই হুড়োহুড়ি পড়ে যায় পার্ক থেকে বেরোনোর জন্য।

উত্তরের টালা থেকে শুরু করে জোড়াবাগান, গৌরীবাড়ি বা দক্ষিণের হাজরা, কলকাতার পার্কগুলির চেহারা এখন কার্যত এমনই। কোনও কোনও পার্কের পাঁচিল ভেঙে পড়ার মুখে। বেশ কিছু পার্ক রক্ষণাবেক্ষণ ও দেখভালের জন্য নেই কোনও নিরাপত্তারক্ষীও। ফলে সেগুলি রাতে হয়ে ওঠে ভবঘুরেদের আস্তানা।

শহর জুড়ে ফলাও করে রয়েছে সৌন্দর্যায়ন নিয়ে বড় বড় বিজ্ঞাপন। কিন্তু যেখানে বিকেলে বাচ্চারা খেলতে যাবে বা বয়স্ক মানুষেরা গিয়ে বসবেন, সেই জায়গারই যদি এমন হতশ্রী চেহারা হয়, তা হলে শহরের সৌন্দর্যায়ন কী ভাবে হবে, সেই প্রশ্ন তুলছেন নাগরিকরাই। তা ছাড়া দেখভালের অভাবে পার্কগুলি হয়ে উঠছে ভবঘুরেদের আস্তানা। ফলে তা কতটা সুরক্ষিত, সে প্রশ্নও উঠেছে।

প্রশাসন সূত্রে জানা গিয়েছে, শুধু পার্কগুলি রক্ষণাবেক্ষণের জন্য একটি নির্দিষ্ট অর্থ পুরসভা প্রতি বছর বরাদ্দ করে। তবে টাকার অভাবে পার্কগুলির দেখভালের ক্ষেত্রে যে খামতি থেকে যাচ্ছে, তা মেনে নিয়েছে পুর-প্রশাসন। পুরসভার ডিজি (পার্ক) দেবাশিস চক্রবর্তী বলেন, ‘‘শুধু পার্কগুলি রক্ষণাবেক্ষণেই পুরসভা প্রতি বছর প্রায় ৪ কোটি টাকা বরাদ্দ করে। কলকাতায় পার্কের সংখ্যা সাড়ে চারশোর কাছাকাছি। তার অনেকগুলিতে মালি নেই।’’ পুরসভার এক আধিকারিকও জানাচ্ছেন, কলকাতার সব পার্কগুলি রক্ষণাবেক্ষণে যা টাকা বরাদ্দ থাকে, তা যথেষ্ট নয়। তিনি আরও জানান, যে সব পার্কে মালি নেই, সেগুলি রক্ষণাবেক্ষণের জন্য অন্য পার্ক থেকে মালি নিয়ে যাওয়া হয়। যেমন, ১২ নম্বর ওয়ার্ডের গৌরীবাড়ি পার্ক। সেটি দেখভালের জন্য মালি নিয়ে যাওয়া হয় দেশপ্রিয় পার্ক থেকে। তবে তা-ও নিয়মিত নয়। যদিও এ কথা মানতে চাননি ১২ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর প্রণতি ঠাকুর। তিনি বলেন, ‘‘পুরো ব্যাপারটা সময়সাপেক্ষ। ধীরে ধীরে সব হবে।’’ ওই পুরকর্তার আরও বক্তব্য, ১০০ দিনের প্রকল্প থেকে প্রতিটি ওয়ার্ডে পার্কের রক্ষণাবেক্ষণ করার জন্য ১০ জন করে কর্মী নিয়োগ করা হয়। তবে তিনি এ-ও মানছেন যে, এমন বেশ কিছু খেলার মাঠ রয়েছে, যেগুলি দেখভালের জন্য নেই কোনও নিরাপত্তারক্ষী।

দক্ষিণের রবীন্দ্র সরোবর কলকাতা ইনপ্রুভমেন্ট ট্রাস্ট (কেআইটি)-র অধীনে। সংস্থার এক আধিকারিকের অভিযোগ, রাজ্য সরকারের তরফ থেকে খুব বেশি সহযোগিতা পাওয়া যায় না। তিনি জানান, রবীন্দ্র সরোবরের মতো বড় উদ্যান রক্ষণাবেক্ষণে মাসিক খরচ প্রায় ১০ লক্ষ টাকা। কিন্তু পার্ক দেখভালের জন্য রয়েছেন মাত্র ৭৫ জন কর্মী।

তবে শহরের পার্কগুলির দেখভালে ঘাটতির কথা মানতে চাননি পুরসভার মেয়র পারিষদ (পার্ক ও উদ্যান) দেবাশিস কুমার। তাঁর কথায়, ‘‘পার্কগুলি পরিষ্কার রাখতে পুরসভা যথেষ্ট সক্রিয়। প্রতিটি পার্কে কর্মীরা আছেন। আগের থেকে পার্কগুলির অবস্থা ভাল। পরিকাঠামো অনুযায়ী চেষ্টা চলছে।’’ বিরোধী কাউন্সলরদের অবশ্য অভিযোগ, পার্ক রক্ষণাবেক্ষণে শুধু টাকা নয়, সদিচ্ছারও অভাব রয়েছে পুরসভার। জোড়াবাগানের ২০ নম্বর ওয়ার্ডের প্রাক্তন কাউন্সিলর অজয় সাহা বলেন, ‘‘কলকাতায় এমন অনেক পার্ক আছে যেখানে নিরাপত্তারক্ষীই মালির কাজ করেন।’’ ৪১ নম্বর ওয়ার্ডের সিপিএম কাউন্সিলর রীতা চৌধুরীর বক্তব্য, ‘‘নেতাজি পার্কে দীর্ঘ দিন ফোয়ারাটি খারাপ। বারবার পুরসভাকে জানালেও তারা সেটি সারাতে উদ্যোগী হয়নি।’’

ছবি: শশাঙ্ক মণ্ডল

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন