ঝড়ের পরে এমনই অবস্থা হয়েছে জাম্পিং বেলুনটির। ছবি: শৌভিক দে
রবিবারের সন্ধ্যা। নিউ টাউনের ইকো পার্কের ‘জাম্পিং বেলুন’-এর উপরে হুটোপাটি করছিল শিশুরা। আচমকা প্রবল ঝ়ড়ে নাইলনের দড়ি ছিঁড়ে খড়কুটোর মতো আকাশে উঠে গেল সেই অতিকায় বেলুন। একটু পরেই আছড়ে পড়ল মাটিতে। আর আতঙ্কে আর্তনাদ করে চার দিকে ছিটকে পড়ল শিশুরা। ওই ঘটনায় জখম ১৩ জনের মধ্যে সঙ্কটজনক অবস্থায় বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন তিন বছরের রিয়ান নায়েক। তার দশ বছরের দিদি মনীষার অবস্থাও ভাল নয়। আরও তিনটি শিশু ওই হাসপাতালেই চিকিৎসাধীন। এই ঘটনায় ইকো পার্ক কর্তৃপক্ষকেই কাঠগড়ায় তুলেছেন অভিভাবকেরা।
সোমবার পুর ও নগরোন্নয়নমন্ত্রী ফিরহাদ হাকিম বলেন, ‘‘ইকো পার্ক কর্তৃপক্ষকে বলেছি, রাজ্য সরকারের আগাম অনুমতি ছাড়া সেখানে কোনও প্রকল্প চালু করা যাবে না। আপাতত ওই রাইড বন্ধ থাকছে। পার্কের সব ক’টি রাইডের নিরাপত্তার দিকটি ইঞ্জিনিয়ারেরা খতিয়ে দেখে রিপোর্ট দেবেন। তার পরে সরকার ঠিক করবে রাইড চলবে কি না। জখম প্রতিটি শিশুর চিকিৎসার খরচ হিডকো বহন করবে।’’
দুর্ঘটনার পরে আহত শিশুদের প্রথমে চিনার পার্ক সংলগ্ন একটি বেসরকারি হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখান থেকে যে পাঁচ জনকে দত্তাবাদে ই এম বাইপাস সংলগ্ন বেসরকারি হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল, তাদের মধ্যে রিয়ান ও মনীষা ছাড়াও ছিল ছ’বছরের যাতিকা, ন’বছরের পূর্বী শর্মা এবং সাত বছরের স্বর্ণিমা কৌশল। ওডিশার বাসিন্দা রিয়ান এবং মনীষা সম্পর্কে ভাই-বোন। এ দিন তাদের বাবা, সেক্টর ফাইভে কর্মরত সুব্রত নায়েক বলেন, ‘‘ছেলের অবস্থা সব চেয়ে খারাপ। ওকে ভেন্টিলেশনে রাখা হয়েছে। চিকিৎসকেরা বলছেন, ৪৮ ঘণ্টার আগে কিছু বলা যাবে না। মেয়ের লিভারে রক্তক্ষরণ হয়েছে। চোট পাওয়ায় মেয়ে ডান দিকের চোখ খুলতেই পারছে না। ডান দিকের হাতও ভেঙেছে।’’
ঘটনার বিবরণ দিতে গিয়ে মা কল্পনা জানান, ১০ মিনিটের রাইড। তখন পাঁচ মিনিটের মতো হয়েছে। রিয়ান, মনীষা-সহ অন্য বাচ্চারা বেলুনের উপরে লাফালাফি করছিল। বাইরে দাঁড়িয়ে অভিভাবকদের কেউ কেউ মোবাইলে সেই ছবি তুলছিলেন। বেলুনের ঢাল বেয়ে নীচে নামার ঠিক আগে দমকা হাওয়ায় বাবা-মায়েদের চোখের সামনেই বেলুনটা উল্টে যায়। ছিটকে পড়ে শিশুরা। মুহূর্তের মধ্যেই জয়রাইড বদলে যায় আতঙ্ক আর কান্নায়।
কল্পনা বলেন, ‘‘আমার ছেলেকে অন্য এক জন অভিভাবক নিজের ছেলে ভেবে তুলেছিলেন। কিছুতেই বুক ছাড়া করছিলেন না। বুঝিয়ে বলায় তিনি রিয়ানকে আমার কোলে দিলেন।’’ ওই অভিভাবক গোবিন্দ বিশ্বাস দক্ষিণ দমদমের গড়ুইয়ের বাসিন্দা। তাঁর দশ বছরের মেয়ে ঈপ্সিতার ঠোঁটে চারটে সেলাই পড়েছে। গোবিন্দ বলেন, ‘‘চোখের সামনে ওই ভয়াবহ ঘটনা ঘটতে দেখলাম। কিছু করতে পারলাম না।’’ আর এক আহত শিশু শ্রেয়ান দাসের বাবা ইন্দ্রজিৎ দাস বলেন, ‘‘যে দৃশ্য দেখলাম, ভাবলে এখনও শিউরে উঠছি। ঝোড়ো হাওয়া এসে বেলুন-সহ ছোট ছোট শিশুদের উড়িয়ে নিয়ে যায়। এক জন নিরাপত্তারক্ষী বেলুন ধরার চেষ্টা করেছিলেন। তাঁকেও ঝড় উড়িয়ে নিয়ে যায়। পরে শুনলাম, ওই নিরাপত্তারক্ষীর হাত ভেঙেছে।’’ শ্রেয়ানের ডান হাতে চিড় ধরেছে।
জখম শিশুর অভিভাবকেরা জানিয়েছেন, উদ্যানের মধ্যে কংক্রিটের রাস্তায় আছড়ে পড়েছিল রিয়ান। মনীষাও কংক্রিটের উপরে পড়ে। সেই জন্যই তাদের চোট এত বেশি। হাসপাতাল সূত্রে জানা গিয়েছে, রিয়ানের মস্তিষ্কের তিন জায়গায় রক্ত জমাট বেঁধে আছে। ইকো পার্ক কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে অব্যবস্থার অভিযোগে সরব হয়েছেন অভিভাবকেরা। গোবিন্দবাবুর কথায়, ‘‘বিপদের সময়ে ইকো পার্ক
কর্তৃপক্ষের যতটা তৎপর হওয়া উচিত ছিল, তাঁরা ততটা হননি।’’ রিয়ানের বাবা বলেন, ‘‘চিৎকার-চেঁচামেচি করার পরে অ্যাম্বুল্যান্স এল।’’ বেহালার বাসিন্দা, জখম শিশু ঋদ্ধিমান হালদারের বাবা বিপ্লব হালদার বলেন, ‘‘ছেলে প্রবল আতঙ্কের মধ্যে আছে। ওই রাইড কতখানি শক্তপোক্ত, তা তো কর্তৃপক্ষের অজানা নয়। তা হলে ঝোড়ো হাওয়া যখন বইতে শুরু করল, তখনই রাইড কেন বন্ধ করে দিল না? উল্টে ১২ জনের জায়গায় ১৬ জনকে রাইডে চাপানো হয়েছিল। যে ভাবে শিশুদের নিয়ে বেলুনটা খড়কুটোর মতো উড়ে গেল, সেটা না দেখলে বিশ্বাস হবে না।’’
হি়ডকো সূত্রের খবর, ওই রাইডের জন্য একটি বেসরকারি সংস্থা বরাত পেয়েছিল। সংস্থার তরফে কোনও গাফিলতি ছিল কি না, তা খতিয়ে দেখতে দুই সদস্যের একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে। হিডকো-র এক আধিকারিক বলেন, ‘‘৮৫ কিলোমিটার বেগের ঝড়কে প্রাকৃতিক বিপর্যয় ছাড়া কিছু বলার নেই। সন্তানেরা আঘাত পেলে অভিভাবকেরা ক্ষুব্ধ হবেন। সেটাই স্বাভাবিক।’’