ছোট্ট মাথার নেই কেন দাম?

বছর কয়েক আগে শহরবাসীকে ‘হেলমেট-শিক্ষা’ দিতে এই লাইনগুলিকেই হাতিয়ার করেছিল পুলিশ। শহর ছেয়ে গিয়েছিল হোর্ডিংয়ে। তবে শহর যে সেই হোর্ডিং দেখে কোনও শিক্ষাই নেয়নি, তার প্রমাণ ছড়িয়ে আছে অলিগলি থেকে রাজপথে। নিজের ছড়ানো বাণী এখন পুলিশই মনে রাখে কি না, সংশয় রয়েছে তা নিয়েও। 

Advertisement

নীলোৎপল বিশ্বাস

শেষ আপডেট: ২০ নভেম্বর ২০১৮ ০০:০০
Share:

অসচেতন: সুরক্ষার পরোয়া না করে এ ভাবেই শিশুদের মোটরবাইকে চাপিয়ে পথে নেমেছেন অভিভাবকেরা। হেদুয়ার অভেদানন্দ রোড। ছবি: দেবস্মিতা ভট্টাচার্য

‘বাবার মাথা ভীষণ দামি, হেলমেটেতে ঢাকা। ছোট্ট মাথার নেই কোনও দাম, আমার মাথা ফাঁকা!’

Advertisement

বছর কয়েক আগে শহরবাসীকে ‘হেলমেট-শিক্ষা’ দিতে এই লাইনগুলিকেই হাতিয়ার করেছিল পুলিশ। শহর ছেয়ে গিয়েছিল হোর্ডিংয়ে। তবে শহর যে সেই হোর্ডিং দেখে কোনও শিক্ষাই নেয়নি, তার প্রমাণ ছড়িয়ে আছে অলিগলি থেকে রাজপথে। নিজের ছড়ানো বাণী এখন পুলিশই মনে রাখে কি না, সংশয় রয়েছে তা নিয়েও।

কারণ, রাস্তার মোড়ে মোড়ে কর্তব্যরত পুলিশকর্মীদের সামনে দিয়েই খালি মাথায় দিব্যি ঘুরে বেড়াচ্ছেন বাইকে সওয়ার মা-বাবারা। কোনও ক্ষেত্রে চালকের মাথায় হেলমেট থাকলেও পিছনের আসনে বা সামনে জ্বালানির ট্যাঙ্কের উপরে বসা শিশুর মাথা থাকছে ফাঁকা। তাঁদের কাউকেই বিশেষ আটকাচ্ছে না পুলিশ!

Advertisement

শ্যামবাজার স্ট্রিট ধরে স্ত্রী এবং একরত্তি মেয়েকে নিয়ে যাচ্ছিলেন সঞ্জয় পাল। মোটরবাইকের পিছনের আসনে মেয়ের স্কুলব্যাগ ধরে বসে সঞ্জয়বাবুর স্ত্রী, সামনে মেয়ে। সঞ্জয়বাবুর মাথা ঢাকা থাকলেও, স্ত্রী ও মেয়ের মাথা ফাঁকাই। বেসামাল গতিতে যতীন্দ্রমোহন অ্যাভিনিউ পেরিয়ে সঞ্জয়বাবু বললেন, ‘‘বুঝতে পারিনি এমন হবে। হাতটা কেঁপে গিয়েছিল।’’ এমন নড়বড়ে ভাবে বাইক চলল, দুর্ঘটনা ঘটলে কী হত? মেয়ে এবং স্ত্রীর মাথায় তো হেলমেটও নেই? হাসিহাসি মুখে সঞ্জয়বাবুর উত্তর, ‘‘ঠিকই বলেছেন। বাড়ি গিয়েই হেলমেট পরাব। ভুলে গিয়েছিলাম।’’ রাস্তায় মাথা ফাঁকা আর বাড়িতে হেলমেট পরিয়ে রাখবেন? মোটরবাইকে গতি তুললেন বিভ্রান্ত সঞ্জয়বাবু। তড়িঘড়ি বললেন, ‘‘চলি।’’

আরও পড়ুন: প্রথম কাজের দিনে পাশ মেট্রো

একই দৃশ্য দেখা গেল কালীঘাট রো়ডে। দুপুর দেড়টা নাগাদ মেয়েকে নিয়ে স্কুল থেকে ফিরছিলেন স্বামী-স্ত্রী। শিশুকন্যাকে বসানো হয়েছে মোটরবাইকের জ্বালানি ট্যাঙ্কের উপরে। বাইক চালাচ্ছেন স্বামী, পিছনের আসনে স্ত্রী। স্বামী-স্ত্রীর মাথায় হেলমেট থাকলেও শিশুকন্যার মাথা ফাঁকাই। রাস্তা পেরোনোর মুখে এমন ভাবেই চালালেন যে, সামনেই জোরে ব্রেক কষে দাঁড়িয়ে গেল একটি লরি। মেয়ের মাথা ফাঁকা রেখে এ ভাবে চালাচ্ছেন? প্রশ্ন শুনেই সটান উত্তর, ‘‘সব ঠিক আছে।’’ আপনার নাম কী? উত্তর না দিয়ে আবার বললেন, ‘‘সব ঠিক আছে।’’ দুর্ঘটনা ঘটলে নিজেকে ক্ষমা করতে পারবেন? উত্তর এল না। বাইক ছুটল জোরে।

কালীঘাট রোডে যেখানে ঘটনাটি ঘটেছে তার সামনেই শাসক দলের বড় পার্টি অফিস। রয়েছে উচ্চমানের নিরাপত্তা ব্যবস্থা। নানা দিকে কর্তব্যরত ট্র্যাফিক পুলিশকর্মীরা দাঁড়িয়ে। শিশুর মাথায় হেলমেট নেই দেখেও বাইকটি থামালেন না কেন তাঁরা? তা ছাড়া শিশু, মা এবং বাবা— এক বাইকে তিন জনের যাত্রাও তো বেআইনি! পুলিশকর্মীর উত্তর, ‘‘স্কুলের বাচ্চা নিয়ে যাচ্ছেন, তাই কিছু বললাম না।’’

শহরের স্কুলগুলি অবশ্য হেলমেটহীন শিশুদের স্কুলে দিতে আসার বিরুদ্ধে কড়াকড়ি করেছে বহুদিন আগেই। নোটিস জারি করে বৌবাজারের একটি স্কুল বলেছিল, ‘নো হেলমেট, নো ক্লাস’। উদ্যোগের প্রশংসা করেছিলেন শিক্ষামন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায়ও। এতে অভিভাবকেরা কিছু দিন সতর্ক থাকলেও সমস্যা মেটেনি বলে জানাচ্ছেন ওই স্কুলেরই অধ্যক্ষা জয়তী বন্দ্যোপাধ্যায়। তাঁর কথায়, ‘‘কড়াকড়ি করেছি বলে অভিভাবকেরা স্কুল থেকে কিছুটা দূরে সন্তানদের নামিয়ে দিয়ে যাচ্ছেন। পুলিশ কেন নিষ্ক্রিয়?’’ লালবাজারের পাল্টা দাবি, পুলিশ মোটেই নিষ্ক্রিয় নয়। এক পুলিশকর্তার কথায়, ‘‘হেলমেট ছাড়া শিশুদের নিয়ে যেতে দেখলেই ধরে জরিমানা নেওয়ার নির্দেশ আছে।’’

পুলি‌শকে ফাঁকি দিয়ে মোটরবাইক যাত্রার দৃশ্য দেখা গেল চেতলাতেও। মোটরবাইক আরোহীর নাম জায়েদ হুসেন। স্ত্রী এবং জায়েদের মাথায় হেলমেট থাকলেও দু’জনের মাঝখানে বসা বছর দশেকের মেয়ের মাথা ফাঁকা। জায়েদ বলেন, ‘‘এত ছোট শিশুর হেলমেট পাব কোথায়?’’ একই ধরনের বক্তব্য বি কে পাল অ্যাভিনিউয়ের বাসিন্দা অমিত জয়সওয়ালেরও। হেদুয়ার অভেদানন্দ রোডে পিছনে দুই কিশোরীকে নিয়ে দাপটে মোটরবাইক চালাতে দেখা গেল তাঁকে।

অমিতের মাথায় হেলমেট থাকলেও স্কুলের পোশাক পরা ওই দুই কিশোরীর মাথা খালি। প্রশ্ন শুনে কিছুক্ষণ অবাক হয়ে থাকলেন অমিত। সামলে নিয়ে বললেন, ‘‘হেলমেট কিনেছিলাম ওদের জন্য। বিশ্বাস করুন, ছোট হয়ে গিয়েছে।’’ উল্টোডাঙার রাজেশ জয়সওয়ালের আবার দাবি, ‘‘ছেলে পরতে চায় না। কাঁদে।’’ সে কারণেই তিনি হেলমেটই কেনেননি বলে জানালেন ওই ব্যক্তি।

শহরের নানা প্রান্তে ঘুরে দেখা গিয়েছে ছোটদের হেলমেট পাওয়া যাচ্ছে সর্বত্রই। দাম ৫০০ থেকে ১৫০০ টাকার মধ্যে। বছর বছর ছোট হয়ে গেলেও কি নিজের সন্তানের নিরাপত্তার কথা ভেবে খরচ করা যায় না সেই অর্থ, প্রশ্ন উঠেছে তা নিয়েও। জানবাজারের মোটরবাইক যন্ত্রাংশের ব্যবসায়ীদের একাংশ অবশ্য বলছেন, আসলে টাকা খরচ না করে কী ভাবে চালিয়ে দেওয়া যায়, সেই চেষ্টাই চলে সর্বত্র। প্রিয়জনের সুরক্ষা সংক্রান্ত সচেতনতার প্রচারেও কাজ হয় না তাই। শোভন সাহা নামে এক ব্যবসায়ীর কথায়, ‘‘চার বছরের বাচ্চারও হেলমেট পাবেন আমাদের কাছে। আসলে বাচ্চা বড় হয়ে গেলে হেলমেটগুলি আর কাজে লাগে না। তাই কেউ কেনেন না।’’ আর এক ব্যবসায়ীর কথায়, অনেকে বড়দের হেলমেটই কেনেন শিশুদের জন্য। এতে শিশুদের ঘাড়ে ব্যথা হয়। তাই হয়তো পরতে চায় না অনেকে।

সন্তানকে হেলমেট না পরিয়ে মোটরবাইক চালানো অভিভাবকদের মধ্যে মাত্র কয়েক জনের সঙ্গেই কথা বলা গিয়েছে। কারণ এমন বাইকচালকদের একটি বড় অংশই বেপরোয়া। ফলে হাত দেখালেও সঙ্গে ক্যামেরা দেখে থামেননি অধিকাংশেই। কেউ আবার প্রশ্ন শুনেই বাইকের গতি বাড়িয়েছেন তড়িঘড়ি। মনোরোগ চিকিৎসক অনিরুদ্ধে দেব বলছেন, ‘‘চূড়ান্ত বেপরোয়া ভাব থেকেই এই ধরনের আচরণ দেখা যায়। দুর্ঘটনার পরে মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরে এসেও অনেকের হুঁশ ফেরে না। যত বার আইন ভাঙবে, তত বার বড় জরিমানা না করলে এই প্রবণতা আটকানো যাবে না।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন