কফি হাউসে আড্ডা ছেড়ে লোকে বেশি ব্যস্ত স্মার্টফোনে 

পরে একাদশ-দ্বাদশ শ্রেণিতে পড়ার সময়ে বিহার থেকে উত্তরপাড়ায় চলে আসি আমরা। শহরটা একটু ধরা-ছোঁয়ার মধ্যে আসে। কিন্তু সম্ভ্রম তখনও অটুট। মনে পড়ে গেল, বি ই কলেজে র‌্যাগিং পিরিয়ডে দক্ষিণ কলকাতার এক সিনিয়র জিজ্ঞেস করেছিল, উত্তরপাড়ায় থাকিস? ওখানে ইলেকট্রিসিটি আছে? সেই শহরের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা হয়ে গেল বি ই কলেজে পড়ার সময় থেকে।

Advertisement

অনিন্দ্য মুখোপাধ্যায় (জ়ুরিখে কর্মরত আর্থিক-প্রযুক্তিকর্মী)

শেষ আপডেট: ২১ জানুয়ারি ২০১৯ ০৩:১১
Share:

সকলেই মগ্ন স্মার্টফোনে।

যেহেতু কলকাতায় বড় হইনি, তাই এই শহরটাকে ছোটবেলা থেকেই বরাবর একটু সম্ভ্রমের চোখে দেখেছি। তখন স্কুলে পড়ি। বিহারের পাঞ্চেত বলে একটা ছোট্ট জায়গায় থাকতাম। ছুটিতে কলকাতায় আসার একটা অন্যরকম রোমাঞ্চ ছিল। বাবার সঙ্গে ট্রেনে করে হাওড়া, তার পরে লঞ্চে করে বাবুঘাট। সেখান থেকে এসপ্লানেড। কখনও আমিনিয়া, কখনও আবার অনাদিতে মোগলাই। তার পরে নিউ মার্কেটে কেনাকাটা। অবাক বিস্ময়ে দেখতাম, বড় শহর, দোকানপাট, লোকজন, তাঁদের চালচলন। আর অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করতাম পরের ছুটির।

Advertisement

পরে একাদশ-দ্বাদশ শ্রেণিতে পড়ার সময়ে বিহার থেকে উত্তরপাড়ায় চলে আসি আমরা। শহরটা একটু ধরা-ছোঁয়ার মধ্যে আসে। কিন্তু সম্ভ্রম তখনও অটুট। মনে পড়ে গেল, বি ই কলেজে র‌্যাগিং পিরিয়ডে দক্ষিণ কলকাতার এক সিনিয়র জিজ্ঞেস করেছিল, উত্তরপাড়ায় থাকিস? ওখানে ইলেকট্রিসিটি আছে? সেই শহরের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা হয়ে গেল বি ই কলেজে পড়ার সময় থেকে।

নদী পেরোলেই কলকাতা। কখনও এসপ্লানেড, কখনও শিয়ালদহ চত্বর আবার কখনও বা রবীন্দ্র সদন। সদ্য প্রেমে পড়েছি, বেশ ভাল রকম ছাত্র রাজনীতি করছি। আর এরই ফাঁকে কখন যেন শহরটা নিজের হয়ে গেল। কখনও শহরের রাজপথে, অলি-গলিতে সঙ্গীদের সঙ্গে মিছিলে হেঁটেছি, কখনও কফি হাউসে গিয়ে আড্ডা মেরেছি বামপন্থার বর্তমান ও ভবিষ্যৎ নিয়ে। আবার কখনও প্রেমিকার সঙ্গে বসে রবীন্দ্র সদন চত্বরে ফিশ ফিঙ্গার কাসুন্দি দিয়ে খেতে খেতে গল্প করে কাটিয়েছি সারাটা দিন। পকেটে পয়সা থাকলে এলগিন রোডে সস্তায় মোমো, অ্যাকাডেমিতে নাটক আর কখনও বা নিউ এম্পায়ার কিংবা লাইটহাউস চত্বরে সিনেমা। না হলে শুধুই ঝালমুড়ি।

Advertisement

তার পরে চাকরি পেলাম। মা-বাবা নিয়ে গেল এসপ্লানেড চত্বরে নতুন জামা-প্যান্ট-টাই কিনে দেওয়ার জন্য। তখনও মধ্যবিত্তদের কেনাকাটা এসপ্লানেড কিংবা গড়িয়াহাটেই সীমাবদ্ধ ছিল। চাকরি সূত্রে যেতে হত সল্টলেকের পাঁচ নম্বর সেক্টরে। উল্টোডাঙা থেকে অটো করে করুণাময়ী, তার পরে করুণাময়ী থেকে আবার অটো করে অফিস। রেস্তরাঁ বলতে শুধু মিশ্রজ তখন। সন্ধ্যা সাতটা, সাড়ে সাতটার পরে নির্জন হয়ে যেত চত্বরটা। বাড়ি ফেরা ছিল একটা বড় সমস্যা। কারণ অটো পাওয়া যেত না। অনেক কিছু ছিল না কিন্তু ওই সময়ে কোনও আফশোসও ছিল না।

তার পরে চাকরি সূত্রে আমি দীর্ঘ ১৮ বছর দেশের বাইরে। গত ১৪ বছর ধরে সুইৎজারল্যান্ডের জ়ুরিখ শহরে রয়েছি। কয়েক সপ্তাহ আগে আবার ঘুরে এলাম কলকাতা থেকে। চোখে পড়ে কলকাতার পরিবর্তনগুলো। বিমানবন্দরটা দারুণ। সন্ধ্যায় আলোয় ঝলমল করছে কলকাতা শহর। বিমান থেকে দারুণ লাগে। রাস্তা দিয়ে আসতে আসতে দেখলাম, রাস্তা জুড়ে রাজনৈতিক নেতা-নেত্রীর নামে হোর্ডিং আর তোরণ। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বিশাল বিশাল কাট আউট সর্বত্র। অনেকটা দক্ষিণের শহরগুলির মতো। উড়ালপুলের পাশে রবীন্দ্র সদন, নন্দন চত্বরটা কেন জানি না একটু ম্রিয়মাণ লাগল। মনে হল দুয়োরানি। বাগবাজারে দেখলাম রসগোল্লা উৎসব চলছে। কফি হাউসে আড্ডা ছেড়ে লোকে বেশি ব্যস্ত স্মার্টফোনে। পাঁচ নম্বর সেক্টর তো চেনাই যায় না। লোকজন, আলো ঝলমল করছে, পরপর রেস্তোরাঁ। শপিং মলগুলোর ফুড কোর্ট উপচে পড়ছে কমবয়সি ছেলেমেয়েদের ভিড়ে। আড্ডা মারাটা এখন আর চায়ের দোকানে হয় না, মূলত কাফে কফি ডে-তেই হয়। আর বাজার হয় স্পেনসার্স, অ্যাক্রোপলিস, প্যান্টালুনস কিংবা মনি স্কোয়ারে। লিন্ডসে, নিউ মার্কেটের নামই কারও মুখে শুনলাম না।

বুঝলাম আমার ভালবাসার শহর পাল্টে গেছে, হয়তো ভালর জন্যই। আমি যে কলকাতাকে চিনতাম, সেটা ছিল বিদ্রোহী কলকাতা। গরিব মানুষের কলকাতা, উঠতি প্রেমিক প্রেমিকার কলকাতা, দুরন্ত বামপন্থী ও অতি বামপন্থী আড্ডার কলকাতা, বইপ্রেমীদের কলকাতা। একটু একটু করে কেমন যেন অন্য বড় শহরগুলোর মতন হয়ে যাচ্ছে আমার শহর। উড়ালপুল, উঁচু উঁচু ফ্ল্যাট বাড়ি, রুফটপ পার্টি, অর্গানাইজড আড্ডা আর যান্ত্রিক এক নাগরিক সমাজ। নতুন কলকাতার আভরণ অনেক, কিন্তু কেমন যেন হৃদয়হীন। একেই বোধ হয় প্রগতি বলে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন