সকালেই নার্সিংহোমে গিয়ে বাবাকে দেখে খুশি মনে বাড়ি ফিরে এসেছিলেন রাজ্য সরকারের এক আমলা। মধ্য রাতে বাড়িতে ফোন। রোগীর যায় যায় অবস্থা। নার্সিংহোমে গিয়ে আমলা গিয়ে দেখেন বাবাকে নিয়ে যমে-মানুষে টানাটানি চলছে।
৬৫ বছরের বৃদ্ধ জন্ডিস নিয়ে ভর্তি হয়েছিলেন। কিন্তু হৃদরোগে আক্রান্ত হওয়ার জন্য তাঁকে আইসিইউতে দেওয়া হয়েছে। বাড়ির লোকে অবাক। মধ্য রাতে নার্সিংহোমে পৌঁছে শুরু হল জবাবদিহি।
সেটা ছিল কালীপুজোর ভাসানের রাত। কালীপুজোর দিন নার্সিংহোমের সব জানলা দরজা বন্ধ করে রাখায় কিছুটা স্বস্তি মিলেছিল। কিন্তু ভাসানের বিসর্জন যখন নার্সিংহোমের কাছাকাছি এল তখন আর শব্দদানবকে রোখা গেল না। তারস্বরে বাজছে ডিজে, বিকট শব্দে একের পর এক বাজি ফাটছে। বন্ধ দরজা জানলা ঠেলে সেই শব্দ গিয়ে ঢুকছে ওয়ার্ডে।
এক চিকিৎসক বলছিলেন, ওই বৃদ্ধ কেঁপে কেঁপে উঠছিলেন থেকে থেকে। আমরা দেখলাম ওঁর পাল্স রেট, রক্তচাপ চড়চড় বাড়ছে। কিছুতেই তা নিয়ন্ত্রণে রাখা যাচ্ছে না। তাই পাঠানো হল আইসিইউতে। একসময় তো ওঁর হৃদপিণ্ড আর পাম্পই করতে পারছিল না। তখনই বাড়ির লোককে ডেকে পাঠানো হয়।
ওই বৃদ্ধের এই অবস্থার জন্য যে বিকট শব্দই দায়ী তা কিন্তু জানাতে ভোলেননি সংশ্লিষ্ট চিকিৎসক।
সত্তরের দশকে মার্কিন পরিবেশ রক্ষা কমিটি প্রথম বারের জন্য শব্দ দূষণকে প্রাণঘাতী বলে আখ্যা দেয়। তারা শব্দসীমাকে ৫৫ ডেসিবেলে বেধে দেয়। সেই সময়েই সমীক্ষকেরা জানিয়ে দিয়েছিলেন, শব্দমাত্রা ৫ ডেসিবেল বাড়লে রক্তচাপ ১.৪ শতাংশ বেড়ে যায়। হৃদরোগের হার বেড়ে যায়১.৮ শতাংশ। আর একটি মার্কিন সমীক্ষা জানাচ্ছে, বহুদিন ধরে উচ্চ শব্দের সংস্পর্শে থাকলে হৃদরোগে মৃত্যুর হার বাড়ে শতকরা তিন ভাগ।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (হু)-র একটি সমীক্ষা বলছে, অনেকে মনে করেন উচ্চ শব্দের মধ্যে থাকতে থাকতে তাঁদের তা গা সওয়া গিয়েছে। তা কিন্তু নয়। আপাতদৃষ্টিতে বিষয়টি সয়ে গিয়েছে বলে মনে হলেও, শরীরের মধ্যে নিত্যদিন তার প্রভাব পড়ছে বলে হু-র সমীক্ষকেরা জানিয়েছেন। হু-র মতে উচ্চ মাত্রার শব্দ এমন একটি ‘স্ট্রেসার’ যা শুধু হৃদপিণ্ডের স্বাভাবিক কাজই ব্যাহত করে না, শরীরে বিভিন্ন হরমোন নিঃসরণ প্রক্রিয়ার স্বাভাবিক ছন্দ নষ্ট করে দেয়। নানা ভাবে শরীরের রোগ প্রতিরোধক বিভিন্ন প্রক্রিয়ার উপরেও প্রভাব ফেলে উচ্চ মাত্রার শব্দ।
প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শারীরবিদ্যার অধ্যাপকের জানাচ্ছেন, কলকাতার বড়বাজার, শিয়ালদহ, পোস্তা এবং হাওড়ার কোনা এক্সপ্রেসওয়ে সংলগ্ন এলাকার বাসিন্দাদের মধ্যে সমীক্ষা চালালে দেখা যাবে সেখানকার অনেক যুবক-যুবতী অনিদ্রা, উচ্চ রক্তচাপ এবং ডায়াবেটিসে ভুগছেন। এর জন্য অনেক কিছুর মধ্যে শব্দ দূষণেরও দায়ভার কোনও অংশে কম নয়।
শারীরবিজ্ঞানীরা আরও মনে করছেন, একা পরিবেশ দফতরকে মাঠে নামিয়ে কোনও লাভই হবে না। শব্দদানব মোকাবিলায় তাদের সঙ্গে পথে নামতে হবে স্বাস্থ্য দফতর এবং পরিবহণ দফতরকেও। গবেষকদের সতর্কতা, অনেক দেরি হয়ে গিয়েছে। নিজেদের বাঁচাতে মানুষকেই নামতে হতে পারে পথে।