চলন্ত বাসে প্রতিবন্ধী যুবককে ‘ধাক্কা’

তখনও সকাল আটটা বাজেনি। তারাতলা মোড় থেকে স্টেট গ্যারাজের দিকে আসছিল ২৫৯ নম্বর বাসটি। গ্যারাজের কাছাকাছি আসতেই চিৎকার শোনা গেল। চলন্ত বাস থেকে ছিটকে বাইরে পড়লেন এক যুবক। রক্তাক্ত অবস্থায় রাস্তায় পড়ে কাতরাতে লাগলেন তিনি।

Advertisement

পারিজাত বন্দ্যোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ১৮ জুলাই ২০১৫ ০০:৪৭
Share:

চিরঞ্জীব সাহা।

তখনও সকাল আটটা বাজেনি। তারাতলা মোড় থেকে স্টেট গ্যারাজের দিকে আসছিল ২৫৯ নম্বর বাসটি। গ্যারাজের কাছাকাছি আসতেই চিৎকার শোনা গেল। চলন্ত বাস থেকে ছিটকে বাইরে পড়লেন এক যুবক। রক্তাক্ত অবস্থায় রাস্তায় পড়ে কাতরাতে লাগলেন তিনি।

Advertisement

বাস অবশ্য থামল না, বরং গতি বেড়ে গেল। বাস থেকে নেমে কেউ সাহায্য করতে এগিয়েও এলেন না। প্রত্যক্ষদর্শীদের কথায়, শুধু কয়েক জন যাত্রীর ভয়ার্থ মুখ বাসের জানলা দিয়ে উঁকি দিল, আবার ঢুকে গেল।

শুক্রবার সকালে বাস থেকে পড়ে যাওয়া ওই যুবকের নাম চিরঞ্জীব সাহা। বাড়ি ঠাকুরপুকুর বাজার অঞ্চলে। সেরিব্রাল পলসি-আক্রান্ত চিরঞ্জীব ভাল করে চলাফেরা করতে পারেন না। কথা বলতে সমস্যা হয়। বুদ্ধির দিক দিয়েও সমবয়সীদের থেকে বেশ কিছুটা পিছিয়ে। ভাড়া নিয়ে বচসার জেরে এ দিন প্রতিবন্ধী এই যুবককেই ২৫৯ বাসের এক কন্ডাক্টর চলন্ত বাস থেকে ধাক্কা মেরে ফেলে দিয়েছেন বলে গুরুতর অভিযোগ উঠেছে। ঠাকুরপুকুর থানায় ওই কন্ডাক্টরের বিরুদ্ধে অভিযোগও দায়ের করেছেন চিরঞ্জীব। স্টেট গ্যারাজের পাশের দোকানের কর্মীরা জানিয়েছেন, বছর বত্রিশের ওই যুবক একটুর জন্য প্রাণে বেঁচেছেন। বাস থেকে পড়ার পরে তাঁর মাথা প্রায় পিছনের চাকার নীচে চলে এসেছিল। শেষ মুহূর্তে দেহটি কোনওমতে সরাতে পারায় বেঁচে যান।

Advertisement

অভিযুক্ত কন্ডাক্টরকে অবশ্য শুক্রবার রাত পর্যন্ত চিহ্নিত করা যায়নি। পুলিশ জানিয়েছে, খোঁজ চলছে। জয়েন্ট কাউন্সিল অব বাস সিন্ডিকেটের বেহালা অঞ্চলের নেতা ইন্দ্রনীল পালকে এ ব্যাপারে জিজ্ঞাসা করা হলে তিনি কোনও খবর পাননি বলে জানান। সঙ্গে তাঁর দাবি, প্রতিবন্ধীদের কার্ড মানতে না চাওয়া বা তাঁদের সঙ্গে বাসকর্মীদের দুর্ব্যবহার আগের থেকে অনেক কমেছে। এখন বাসকর্মীরা অনেক সচেতন। তাঁরা জানেন, প্রতিবন্ধীদের হেনস্থা করলে পুলিশের ঝামেলায় পড়তে হতে পারে, বাসের লাইসেন্স বাজেয়াপ্ত হতে পারে বা তাঁদের চাকরি যেতে পারে।

নিজের বাড়ির খাটে শুইয়ে থাকা চিরঞ্জীব অবশ্য জানিয়েছেন, সচেতনতা বা সহমর্মিতার ছিঁটেফোঁটাও তিনি বাসকর্মীদের থেকে পাননি। তিনি তারাতলায় ‘ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অব সেরিব্রাল পলসি’ (আইআইসিপি)-র বৃত্তিমূলক শিক্ষা বিভাগে চা প্যাকেজিং বিভাগের কর্মী। প্রায় ১০ বছর ধরে ওই কাজ করছেন। বলেন, ‘‘চলাফেরার সমস্যা হলেও নিজের পায়ে দাঁড়াব বলে রোজ সকালে একা বাসে করে ইনস্টিটিউটে যাই। মাসে কিছু ভাতা পাই। এ দিনও বাসে ওঠার পরে আমার প্রতিবন্ধী কার্ডটা কন্ডাক্টরকে দেখাই। তখন তিনি কার্ডটা হাত থেকে কেড়ে নিয়ে সিটের নীচে ফেলে দেন। জানান, ওই কার্ড তিনি মানেন না, ভাড়া দিতে হবে। আমি তার প্রতিবাদ করি।’’

চিরঞ্জীবের অভিযোগ, এর পরেই ওই কন্ডাক্টর তাঁকে বাস থেকে নেমে যেতে বলেন এবং অশ্লীল গালিগালাজ করেন। তখন নির্দিষ্ট স্টপ পেরিয়ে যাচ্ছে দেখে চিরঞ্জীব বাস থামাতে বলেন, কিন্তু বাস থামে না। তাঁর অভিযোগ, ‘‘আমি বাস থামানোর জন্য চিৎকার করে উঠলে স্টেট গ্যারাজের কাছাকাছি ওই কন্ডাক্টর আমাকে ধাক্কা মেরে বাসের বাইরে ফেলে দেন। যাত্রীরা কেউ সাহায্যের জন্য এগিয়ে আসেননি।’’ আইআইসিপি-র ডেপুটি ডিরেক্টর শুভ্রা চট্টোপাধ্যায়ের কথায়, ‘‘চিরঞ্জীব রাস্তাতেই পড়েছিলেন। বেশ কিছুক্ষণ পরে খবর পেয়ে আমাদের ইনস্টিটিউট থেকে লোকজন গিয়ে তাঁকে চিকিৎসকের কাছে নিয়ে যান ও থানায় ডায়রি করা হয়। কেউই সাহায্যের জন্য এগোলেন না বা কনডাক্টরের কাজের প্রতিবাদ করলেন না। এ কোন সমাজে রয়েছি আমরা!’’

সেরিব্রাল পলসি আক্রান্তদের অধিকার আন্দোলনের সঙ্গে জড়িত জিজা ঘোষ অবশ্য জানিয়েছেন, প্রতিবন্ধীদের প্রতি সমাজের একাংশের আক্রোশ ভুরি-ভুরি নিদর্শন রয়েছে। তাঁকেও এক সময়ে বিমান থেকে নামিয়ে দেওয়া হয়েছিল। বেসরকারি বাসে প্রতিবন্ধী কার্ড মানতে না চাওয়া, প্রতিবন্ধী আসন না ছাড়া, সহযাত্রী এবং বাসকর্মীদের ব্যঙ্গ নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার। অনেকে এই মানুষদের পাশে বসতে চান না। জিজার কথায়, ‘‘আমাদের অনেকেরই বাসে ওঠা-নামায় একটু সময় লাগে। সেই সময়টুকু বাসকর্মীরা আমাদের দিতে চান না। পারলে ধাক্কা দিয়ে নামিয়ে দেন।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন