থানার হেঁশেলেই নতুন জীবন

এ ক্ষেত্রে অবশ্য উল্টো অবস্থানে থাকা কিছু মানুষের সদিচ্ছা শেষ পর্যন্ত বেশি শক্তিশালী প্রমাণিত হয়েছে। তাই সেই ‘পাগলেরাই’ জমিয়ে রান্না করছেন আর পুলিশ কব্জি ডুবিয়ে দু’বেলা খাচ্ছে!

Advertisement

পারিজাত বন্দ্যোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ১৩ জানুয়ারি ২০১৮ ০১:৩১
Share:

জমজমাট: এ ভাবেই চলছে ক্যান্টিন। শুক্রবার, হেস্টিংস থানায়। —নিজস্ব চিত্র।

আপত্তি করার লোকের অভাব ছিল না। অনেকেই নাক কুঁচকে প্রশ্ন তুলতেন, ‘পাগলেরা রান্না করবে! সে জিনিস মুখে তোলা যাবে? নোংরা-টোংরা ঠিকঠাক পরিষ্কার করবে তো?’

Advertisement

এ ক্ষেত্রে অবশ্য উল্টো অবস্থানে থাকা কিছু মানুষের সদিচ্ছা শেষ পর্যন্ত বেশি শক্তিশালী প্রমাণিত হয়েছে। তাই সেই ‘পাগলেরাই’ জমিয়ে রান্না করছেন আর পুলিশ কব্জি ডুবিয়ে দু’বেলা খাচ্ছে!

পুলিশের রসনাতৃপ্তির কথা আলাদা করে আসছে কারণ, রান্নাটা হচ্ছে থানার ক্যান্টিনে! হেস্টিংস থানার সেই ক্যান্টিনে পুলিশের পাশাপাশি বাইরের লোকেরাও খেতে আসেন। এই প্রথম কোনও সরকারি জায়গায় ক্যান্টিন চালানোর পরিপূর্ণ দায়িত্ব পেয়েছেন তথাকথিত ‘পাগলরা’। যাঁদের মধ্যে কেউ কেউ ঘরবাড়ি ছাড়া হয়ে ছেঁড়া পোশাক, ধুলোমাখা গায়ে পথে ঘুরে বেড়িয়েছেন, কেউ আবার বাড়িতেই ঘরবন্দি থেকে লোকের বিরক্তি আর গঞ্জনা সয়েছেন।

Advertisement

গত ডিসেম্বর মাস থেকে সেই বীণা থাপা, সৌমিত্র গুহ, দীপক চৌধুরী, সাকিনা খাতুনেরাই হাতা-খুন্তি হাতে কোমর বেঁধে তুমুল দক্ষতায় ক্যান্টিন সামলাচ্ছেন। কোথাও এতটুকু গোলমাল হচ্ছে না। বীণাদির হাতের চিংড়ির মালাইকারি, সাকিনাদির রাঁধা কচি পাঁঠার ঝোল মুগ্ধ হয়ে খাচ্ছে পুলিশবাহিনী। সৌমিত্রদা, দীপকদাদের দায়িত্বে রয়েছে হিসেবপত্র রাখা, বাজার আর পরিবেশন। আমিষ থালি ৪৫ টাকা আর নিরামিষ থালি ৪০ টাকা মুহূর্তে নিঃশেষ হচ্ছে। চারপাশ থেকে একটু সহযোগিতা আর বিশ্বাস পেলে অনেকের অবিশ্বাস দূর করে পায়ের নীচে জমি তৈরি করা যায়, তা প্রমাণ করছেন মানুষগুলো। মানসিক সমস্যার জন্য ওষুধ তাঁদের এখনও চলছে, তাতে অসুবিধে হচ্ছে না তাঁদের কাজে।

হেস্টিংস থানাতেই ২০০৯ সাল থেকে মানসিক রোগী ভবঘুরেদের জন্য একটি ডে কেয়ার সেন্টার চালাত চেতলার এক স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা। সেখানে সকাল থেকে রাত পর্যন্ত অসহায় মানুষেরা একটু বিশ্রাম করতে পারতেন, দুপুরের খাবার পেতেন, বিনিময়ে তাঁরা থানার চত্বরে সুন্দর একটা ফুলের বাগান তৈরি করেছিলেন। গত বছর অক্টোবর মাসে থানা পরিদর্শনে আসেন পুলিশের বড় কর্তারা। তখনই মানসিক সমস্যায় ভোগা মানুষগুলির পাকাপাকি পুনর্বাসন নিয়ে কথা ওঠে। অনুমতি মেলে ক্যান্টিন চালানোর। বীণা থাপা বলেন, ‘‘আত্মবিশ্বাসটাই চলে গিয়েছিল। প্রথমে ক্যান্টিন চালানোর কথা শুনে তাই বিশ্বাস করতে পারিনি। আসলে স্বাভাবিক জীবনে ফেরার জন্য অন্যদের ভরসা পাওয়া খুব জরুরি।’’

২০১১ সালে ভবানীপুরের নর্দার্ন পার্ক এলাকায় মনোরোগীদের জন্য স্বাস্থ্যশিবির চলাকালীন পাওয়া গিয়েছিল উস্কোখুস্কো দীপক চৌধুরীকে। বাবা-মা মারা যাওয়ার পরে আত্মীয়েরা তাঁকে তাড়িয়ে দেন। আত্মীয়দের বেধড়ক মার খেয়ে ঘর ছাড়তে হয়েছিল সৌমিত্রবাবুকেও। ক্যান্টিনে খাবার পরিবেশন করতে করতে বলছিলেন, ‘‘সবাই আমায় হারা পাগলা বলত। ঢিল মারত, তাড়িয়ে দিত। এখন আমার বেড়ে দেওয়া খাবার পুলিশ খাচ্ছে, এখনও আমার বিশ্বাস হয় না।’’

ওই স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের প্রধান সর্বাণী দাস রায়ের কথায়, ‘‘চারপাশের মানুষ আর সমাজের এই সহযোগিতা খুব দরকার। কারণ, মানসিক রোগ যে পর্যায়ে বাড়ছে, তাতে কেউই নিজেকে নিরাপদ মনে করতে পারেন না। কখন, কার যে এই সাহায্যের হাত দরকার হবে, সহানুভূতির প্রয়োজন হবে কেউ বলতে পারে না।’’ বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা তো গত বছরের শুরুতেই ভারতকে হুঁশিয়ারি দিয়েছিল। কারণ তাদের সমীক্ষাতেই উঠে এসেছিল, ভারতে প্রায় সাড়ে পাঁচ কোটি মানুষ মানসিক অবসাদের শিকার। প্রায় ৪ কোটি মানুষ ভুগছেন ‘অ্যাংজাইটি ডিসর্ডার’-এ। সর্বাণীদের সংস্থাই ২০১২ থেকে ২০১৭-র মধ্যে কলকাতার ৪৩টি ওয়ার্ডে ৪৩৪ জন মানসিক রোগী ভবঘুরেকে চিকিৎসার আওতায় এনেছে। কলকাতা পুরসভার সঙ্গে যৌথ ভাবে ৭৮ ও ৮২ নম্বর ওয়ার্ডের বস্তি এলাকায় গত দু’-তিন বছরে ২৫২৭ জন মনোরোগীর চিকিৎসা করেছে তারা। এই কলকাতাতেও কী হারে মানসিক রোগ বাড়ছে, তার একটা আন্দাজ এর থেকে মেলে। কিন্তু অভিযোগ, সরকারি তরফে মনোরোগীদের পুনর্বাসন প্রক্রিয়া এখনও নামমাত্র।

২০১১ সালে স্বাস্থ্য দফতর থেকে ‘স্টেট মেন্টাল হেলথ অথরিটি’ নামে একটি কমিটি তৈরি হয়। কমিটির অন্যতম সদস্য মোহিত রণদীপই জানালেন, একের পর এক পুনর্বাসন প্রস্তাব লালফিতের ফাঁসে বন্ধ হয়ে রয়েছে। এ সবের মধ্যে হঠাৎ পুলিশ ক্যান্টিনের রান্নার সুবাস টাটকা প্রত্যাশা নিয়ে এসেছে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন