ফেসবুকে জমজমাট ‘দারোগার দফতর’

লন্ডন স্কুল অব ইকনমিকস্-এর অধ্যাপক, অর্থনীতিবিদ মৈত্রীশ ঘটক বললেন, ‘‘এ জিনিস বোধহয় শুধু কলকাতাতেই সম্ভব। কয়েকটা লেখা প়ড়েছি।

Advertisement

অমিতাভ গুপ্ত

শেষ আপডেট: ১৮ অগস্ট ২০১৭ ০৯:০০
Share:

মেঘের আড়াল থেকে শর নিক্ষেপ করছেন কোনও মেঘনাদ। আর, তাতে সানন্দ ঘায়েল নেটিজেনরা।

Advertisement

কলকাতা পুলিশের ফেসবুক পেজ জমজমাট। পুলিশের হাতে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের প্রায়-নাকাল হওয়ার গল্প থেকে সিকি শতাব্দী আগে হওয়া রহস্যজনক খুনের বিবরণ, আর সদ্য ঘটা অপরাধের তদন্তের গতিপ্রকৃতি, প্রতি দিন নতুন নতুন গল্প হাজির ফেসবুকে। গুরুদ্বারের প্রণামীর বাক্স ভেঙে টাকা নিয়ে গা ঢাকা দেওয়া অপরাধী ধরা প়ড়ল কী ভাবে, বাংলাদেশ থেকে চিকিৎসা করাতে কলকাতায় আসা জাহিদা চাচির পাসপোর্ট চুরি হয়ে যাওয়ার পর কী ভাবে পুলিশ তাঁর পাশে দাঁড়াল, রোজ সকালে এমনই সব কাহিনি শেয়ার হচ্ছে এক ওয়াল থেকে অন্য ওয়ালে। ঝরঝরে ভাষার গুণে প্রায় রহস্য-সাহিত্য হয়ে উঠছে সে সব পোস্ট।

লন্ডন স্কুল অব ইকনমিকস্-এর অধ্যাপক, অর্থনীতিবিদ মৈত্রীশ ঘটক বললেন, ‘‘এ জিনিস বোধহয় শুধু কলকাতাতেই সম্ভব। কয়েকটা লেখা প়ড়েছি। অত্যন্ত পাকা হাতের ছাপ রয়েছে। কোনও পদস্থ পুলিশকর্তা এমন বাংলা আর ইংরেজি লিখছেন, ভাবতে ভাল লাগছে।’’ একটা পুরনো গল্প মনে করিয়ে দিলেন অধ্যাপক ঘটক। কলকাতায় শ্যুটিং করতে এসেছেন ফরাসি চিত্রপরিচালক লুই মাল। শ্যুটিংয়ের সময় এক পুলিশ অফিসার তাঁর পরিচয় জানতে চান, আর নাম শুনেই খুশি হয়ে তাঁর প্রথম ছবির নামই শুধু উল্লেখ করেননি, ভিড়ের উপরে হালকা লাঠিচার্জও করিয়ে দেন, যাতে অশান্ত কলকাতার ছবি তাঁর ক্যামেরায় ধরা পড়ে। লুই মাল পরে বলেছিলেন, এ জিনিস বিশ্বের আর কোথাও হতেই পারে না।

Advertisement

সত্যিই সম্ভবত আর কোনও শহরের পুলিশের এমন ফেসবুক পেজ নেই, যেখানে রহস্য সমাধানের গল্প হাতেগরম পড়ে নেওয়া যায়। কলকাতাই প্রথম। প্রতি দিন কে লিখছেন এই পোস্টগুলো? কলকাতা পুলিশের সূত্র বলছে, তিনি অতিরিক্ত কমিশনার (৩) সুপ্রতিম সরকার। ১৯৯৭ সালের ব্যাচের আইপিএস অফিসার সুপ্রতিমবাবু অবশ্য সরাসরি স্বীকার করতে নারাজ। বললেন, ‘‘ব্যক্তির পরিচয়টাকে গুরুত্ব না দেওয়াই ভাল। এটা কলকাতা পুলিশের লেখা, সেটাই আসল।’’ যদিও অভিযোগও আছে। কোনও কোনও মহল থেকে বলা হয়, সম্প্রতি বহু ঘটনায় পুলিশের ভূমিকা নিয়ে অভিযোগ উঠলে তা খণ্ডনের জন্য ফেসবুক পেজকেই বেছে নিচ্ছেন পুলিশকর্তারা।

ফেসবুকে পুলিশি তদন্তের কাহিনি লেখার পরিকল্পনা পুলিশ কমিশনার রাজীব কুমারের। নাগরিকদের মধ্যে পুলিশ সম্বন্ধে নেতিবাচক ধারণা খানিক হলেও দূর করার তাগিদ থেকেই শুধু সোশ্যাল মিডিয়ায় সাধারণ মানুষের কাছে পৌঁছনোর এই প্রকল্প। সমাজতত্ত্ববিদ প্রশান্ত রায় বললেন, ‘‘যখনই পুলিশ মনে করে যে সাধারণ মানুষের মনে তাদের প্রতি বিশ্বাসের ঘাটতি হয়েছে, তখনই মানুষের কাছে পৌঁছনোর একটা তাগিদ দেখা যায়। আগে পুলিশ স্থানীয় মানুষের সঙ্গে ফুটবল খেলেছে। এখন সোশ্যাল মিডিয়ায় জনসংযোগ করছে। আসল কথাটা হল মানুষের কাছে একটা বার্তা পৌঁছে দেওয়া— পুলিশ মানেই খারাপ লোক নয়।’’

সাড়া মিলছে সাধারণ মানুষের থেকে? সুপ্রতিমবাবু জানালেন, উপচে পড়ছে ইনবক্স। বহু মানুষ সাহস করে নিজেদের সমস্যার কথা খুলে বলছেন। সাড়া পড়েছে পুলিশকর্মীদের মধ্যেও। কনস্টেবল থেকে সাব ইনস্পেক্টর, এত দিন যাঁদের কাজ নেপথ্যেই থেকে যেত, পুলিশের ফেসবুক পেজে
ছবি-সহ কৃতিত্বের কথা প্রকাশিত হওয়ায় তাঁদের মধ্যে ভাল কাজ করার একটা সুস্থ প্রতিযোগিতাও তৈরি হয়েছে বলে তাঁর মত।

যে নিচুতলার পুলিশকর্মীদের শুধু নির্দেশ পালন করতে হয়, সিদ্ধান্ত গ্রহণে যাঁদের হাত নেই, এ ভাবে কি তাঁদের ভাল কাজ করতে উদ্বুদ্ধ করা সম্ভব? মনোবিদ জয়ন্তী বসু বললেন, ‘‘সম্ভব। প্রথম কথা, পুলিশের পক্ষে কতখানি করা সম্ভব, কত দূর অবধি এগোলে তাতে উপরমহলের আপত্তি থাকবে না, সেটা নিচুতলার অনেক কর্মীই জানেন না। ফেসবুক পেজের স্বীকৃতিতে সেই গণ্ডিটা স্পষ্ট হবে। দ্বিতীয়ত, সাধারণ মানুষের মনে যদি পুলিশ সম্বন্ধে নেতিবাচক ধারণা খানিক হলেও কমে, তা হলে পুলিশের সঙ্গে তাঁদের কথাবার্তায় সেই পরিবর্তনটার ছাপ পড়বে। তাঁরা অনেক খোলা মনে কথা বলবেন। উল্টো দিকের মানুষের ব্যবহারের প্রভাব আমাদের প্রত্যেকের ব্যবহারের উপরেই কম-বেশি পড়ে। পুলিশকর্মীরাও ইতিবাচক ব্যবহার পেলে অনেক বেশি ইতিবাচক হবেন বলে আশা করা যায়।’’

নেটিজেনরা রহস্য-কাহিনি পড়ার নেশায় মশগুল। কল্পনার ভেজাল ছাড়াই যদি জমজমাট গল্পের জোগান মেলে রোজ, বাঙালির আর কী চাই!

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন