মেসে বসত করে কোন জনা, কেউ তা জানে না

মেসমালিকদের সচেতন করতে পুরসভা প্রচার করেছে। পুলিশের ওয়েবসাইটেও ফর্ম মেলে। তবু বহু মেস মালিকই আবাসিকদের নথি থানা কিংবা পুরসভায় জমা দেন না।

Advertisement

গৌরব বিশ্বাস ও আর্যভট্ট খান

শেষ আপডেট: ০৩ ডিসেম্বর ২০১৭ ০২:৪২
Share:

আস্তানা: দমদমের একটি মেস। ছবি: শৌভিক দে

বিশ্বাসে মিলায় মেস, পরিচয়পত্র বহু দূর!

Advertisement

মেসমালিকদের সচেতন করতে পুরসভা প্রচার করেছে। পুলিশের ওয়েবসাইটেও ফর্ম মেলে। তবু বহু মেস মালিকই আবাসিকদের নথি থানা কিংবা পুরসভায় জমা দেন না। দমদম, শিয়ালদহ কিংবা বেলঘরিয়ার মতো বেশ কিছু মেসবাড়িতে ঢুঁ মারলেই মালুম হয়, সে অভিযোগ কিন্তু অমূলক নয়।

বছর কয়েক আগে খাগড়াগড় বিস্ফোরণ কাণ্ডের পরে চমকে গিয়েছিল তামাম দেশ। জানা গিয়েছে, মৃত, ধৃত ও পলাতকদের অনেকেই
এ দেশের নাগরিক নয়। অথচ এ দেশের ভোটার কার্ড-সহ অন্য পরিচয়পত্র তৈরি করে ভাড়া বাড়ি বদলে নিশ্চিন্তে সন্ত্রাসের সলতে পাকানো হচ্ছিল। এর পরেই টনক নড়ে প্রশাসনের। ভাড়়াটেদের তথ্য সংগ্রহ করতে অতিসক্রিয় হয় পুরসভা-পঞ্চায়েত-পুলিশ। কিন্তু ফের যে কে সেই। হালে কলকাতা স্টেশন থেকে কয়েক জন জঙ্গি ধরা পড়ায় আবার কিছুটা নড়ে বসছে প্রশাসন। ধৃতেরা হাওড়ার একটি লজে উঠেছিল। তাই এ বার মেসের পাশাপাশি পুলিশি নজরদারিতে রয়েছে হোটেল এবং লজগুলিও।

Advertisement

দমদম স্টেশন লাগোয়া একটি মেসের আবাসিক জানাচ্ছেন, খাগড়াগড় কাণ্ডের সময় ভাড়াবাড়ি নিয়ে বাড়াবাড়ি শুরু হলেও তাঁর মেসে কিন্তু আঁচ পড়েনি। ওই আবাসিক বলছেন, ‘‘এই মেসে এক বন্ধুর মাধ্যমে এসেছিলাম। কোনও পরিচয়পত্র চাননি মেসমালিক। অন্যদের থেকে নিয়েছেন কি না জানি না।’’

মেসের মালিকের দাবি, ‘‘পুরনো যাঁরা আছেন, তাঁরা ভাল ছেলে। তাঁদের বিশ্বাসও করি। কিন্তু নতুন যাঁরা আসেন, তাঁদের সকলের ভোটার কার্ড বা আধার কার্ডের ফোটোকপি নিয়ে রাখি।’’ সেই নথি কি পুরসভা বা পুলিশের কাছে জমা দেন? তার উত্তর মেলেনি।

দমদম স্টেশন লাগোয়া ঘোষপাড়া, ফকির ঘোষ লেন-সহ বিভিন্ন পাড়ায় ঢুঁ মারলে দেখা মেলে এমন বহু মেসবাড়ির। কোথাও ফ্ল্যাট, কোথাও বাড়ির একটি ঘরেই তিনটে-চারটে তক্তপোষ। থাকা-পড়া-আড্ডা-ঘুম সেখানেই। কেউ এসেছেন পড়তে, কেউ কর্মসূত্রে। কেউ আবার কেন যে আছেন, তা-ও এক রহস্য।

ঘোষপাড়ার বাসিন্দা অনিন্দ্য বসু বলছেন, ‘‘এই এলাকায় হাজার দু’য়েক বাসিন্দা থাকেন। আমার মতো আদি বাসিন্দা বড়জোর শ’পাঁচেক। বাকিরা বেশির ভাগই মেসের বাসিন্দা। তাঁদের সে ভাবে চিনিও না।’’ এক আবাসিক বলছেন, ‘‘সকালে অফিস যাই। ফিরি রাতে। পাড়ার লোকজন তো দূর, পাশের ঘরে যাঁরা থাকেন, তাঁদেরকেই তো ঠিক মতো চিনি না!’’

মেসমালিক দুর্গা সাহু জানাচ্ছেন, তাঁরা আবাসিকদের থেকে ভোটার কার্ড, আধার কার্ডের প্রতিলিপি নিয়ে রাখেন। থানায় বা পুরসভায় জমা দেওয়া হয় না। কারণ, অনেকেই দু’-তিন মাস থেকে অন্যত্র চলে যান। দুর্গাবাবুর দাবি, ‘‘পুলিশ চাইলে সব তথ্য দেখাতে পারি।’’

দক্ষিণ দমদম পুরসভার চেয়ারম্যান জানান, তাঁরা প্রতিবেশী বা অন্য আবাসিকদের দেওয়া তথ্যের উপরেই নির্ভরশীল। দক্ষিণ দমদম পুরসভার ১৩ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর প্রবীর পালের কথায়, ‘‘পুলিশের মতো পুরসভার তরফেও একটা ফর্ম ছাপা হয়েছে। কিন্তু মেসের মালিকদের তৎপরতা দেখা যায় না।’’ একই সুর কামারহাটির চেয়ারম্যান গোপাল সাহার গলায়। তিনিও বলেন, ‘‘পুলিশের মতো কামারহাটি পুরসভা থেকেও ফর্ম পাওয়া যায়। মেসমালিকদের এ নিয়ে বারবার সচেতন করা হয়েছে। পুর প্রতিনিধিদের মাধ্যমে সেই বার্তা পৌঁছিয়ে দেওয়াও হয়েছে। তবে মানুষ কতটা তা মানছেন সেটা পুলিশ বলতে পারবে।’’ কলকাতা পুরসভার মেয়র শোভন চট্টোপাধ্যায় মানছেন যে মেসে ভাড়াটেদের নথি রাখতে পুরসভার দায়িত্ব রয়েছে। কী করে তা পালন করে পুরসভা? কোনও স্পষ্ট উত্তর দিতে পারেননি মেয়র। তিনি জানান, পুরসভা দায়িত্ব পালন করবে।

পুলিশ জানাচ্ছে, আবাসিকরা তাঁদের পরিচয়পত্র জমা দেবেন মেস মালিকদের কাছে, এটাই নিয়ম। কর্তৃপক্ষ তার প্রতিলিপি জমা দেবেন স্থানীয় থানা ও পুরসভায়। সেটা কী হচ্ছে? ব্যারাকপুর কমিশনারেটের ডেপুটি কমিশনার ধ্রুবজ্যোতি দে বলেন, ‘‘বহু বার মেস মালিকদের বলেছি। কিন্তু বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই দেখা গিয়েছে, লোকজন এখনও সচেতন নন।’’

ধ্রুবজ্যোতিবাবু বলছেন, ‘‘যারা ঘন ঘন বাসা বদলান, তাঁদের নজরে রাখা কঠিন কাজ। তাই আবাসিকদের অনুরোধ করছি, মেসে আসা নতুন লোকের সঙ্গে ভাব জমাতে। সন্দেহ হলেই পুলিশে খবর দিন তাঁরা। এই ধরনের ‘নেবারহুড ইনটেলিজেন্সি’ থাকলে সমস্যা অনেক কমবে।’’

প্রশ্ন হল, কত অচেনা মুখের ভিড় বাড়লে সচেতন হবে কলকাতা?

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন