উর্দিভরা ব্যাগ নিয়ে গায়েব রিকশা, হন্যে পুলিশ

ঝোপঝাড়ের মধ্যে পড়েছিল ব্যাগটা। ভিতর থেকে উঁকি দিচ্ছে সাদা একটি জামা, তার কাঁধের কাছে ব্যাজে দুটি তারা। পাশে ঝোপের মধ্যেই পড়ে রয়েছে রিভলভার এবং গুলির খালি খাপ, বেল্ট! সোমবার দুপুরে বনহুগলি বিকেসি কলেজের উল্টো দিকে ঝিলপাড়ে এ ভাবে পড়ে থাকা কলকাতা পুলিশের উর্দিটি দেখে চমকে গিয়েছিলেন স্থানীয়েরা।

Advertisement

নিজস্ব সংবাদদাতা

শেষ আপডেট: ০১ নভেম্বর ২০১৬ ০০:৩৩
Share:

অলঙ্করণ: ওঙ্কারনাথ ভট্টাচার্য

ঝোপঝাড়ের মধ্যে পড়েছিল ব্যাগটা। ভিতর থেকে উঁকি দিচ্ছে সাদা একটি জামা, তার কাঁধের কাছে ব্যাজে দুটি তারা। পাশে ঝোপের মধ্যেই পড়ে রয়েছে রিভলভার এবং গুলির খালি খাপ, বেল্ট!

Advertisement

সোমবার দুপুরে বনহুগলি বিকেসি কলেজের উল্টো দিকে ঝিলপাড়ে এ ভাবে পড়ে থাকা কলকাতা পুলিশের উর্দিটি দেখে চমকে গিয়েছিলেন স্থানীয়েরা। কেন ঝিলের পাড়ে তা এমন ভাবে পড়ে থাকবে— সে বিষয়ে স্থানীয় বাসিন্দা থেকে তদন্তকারী পুলিশ অফিসার, সকলের মধ্যেই তৈরি হয়েছিল হাজারো সংশয়, প্রশ্ন। পরিত্যক্ত ওই ব্যাগকে ঘিরে ভরদুপুরের জটলায় তখন কেউ বলছেন, হয়তো ঝিলের জলে ডুব দিয়ে আত্মহত্যা করেছেন ওই অফিসার। কেউ বা দাবি করছিলেন, তাঁকে খুন করে ঝোপে বা ঝিলে ফেলে দেওয়া হয়েছে।

‘খারাপ’ কিছু ঘটেছে ধরে নিয়ে ঝিলের চারপাশের ঝোপজঙ্গলে দেদার তল্লাশি চালালো পুলিশও। কিন্তু কোথাও কিছুই মেলে না! বেজায় চিন্তায় পড়ে শেষমেশ তদন্তকারীরা ঠিক করলেন, ঝিলে ডুবুরি নামিয়ে তল্লাশি চালাবেন। তা না হলে পুলিশের উর্দি উদ্ধারের রহস্য জানা যাবে না।

Advertisement

ইতিমধ্যে ব্যাগ খুলে উর্দি বার করে ফেলেছেন বরাহনগর থানার পুলিশকর্মীরা। তার বুকপকেটের কাছে সাঁটা নেমপ্লেটে লেখা ‘স্বপনকুমার দাস-এসআই’। এমনকী পকেট থেকে পাওয়া সিসি-তেও লেখা রয়েছে ওই একই নাম। এ ছাড়াও পকেটে রয়েছে এক দাঁতের চিকিৎসকের প্রেসক্রিপশন। কিন্তু কে সেই স্বপনকুমার দাস, জানতে না পারায় অগত্যা জামা, বেল্ট, টুপি, চশমা, রিভলভার এবং গুলির খালি খাপ ফের ব্যাগে ভরে থানার দিকে রওনা দিলেন তদন্তকারীরা।

দুপুর সাড়ে ১২টা থেকে ঝিলপাড়ে প্রায় আধ ঘণ্টার এই ব্যাগ রহস্যেই তোলপাড়া গোটা পাড়া। আসল ঘটনা অবশ্য জানা গেল খানিকক্ষণ পরেই। জানা গেল, খুন-আত্মহত্যা কিছুই নয়। আসলে চুরি গিয়েছিল ওই ব্যাগ। দুপুর সওয়া ১টা নাগাদ হন্তদন্ত হয়ে বিকেসি কলেজের উল্টো দিকের ওই ঝিলের সামনে এসে এক রিকশাচালকের সন্ধান করতে গিয়েই ব্যাগের সন্ধান পেলেন খোদ ব্যাগের মালিক! কলকাতা পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগের এসআই স্বপনকুমার দাস।

কী ভাবে হারাল গোয়েন্দা অফিসারের ব্যাগ?

রবিবার তৃণমূল ভবনে ডিউটি সেরে লালবাজারে রিভলভার, গুলি জমা দিয়ে সেগুলির খালি খাপ, জামা, টুপি, বেল্ট ছোট একটি ব্যাগে ভরে বাসে চাপেন স্বপনবাবু। রাত সাড়ে ১০টা নাগাদ ডানলপে বাস থেকে নেমে পরিচিত এক যুবক বাপির সাহায্যেই রিকশা জোগাড় করে বেলঘরিয়া পুলিশ আবাসনের দিকে রওনাও দেন। এমনকী এত রাতে যাওয়ার জন্য রিকশা চালককে ৩০ টাকা ভাড়াও দিতে রাজি হয়েছিলেন কলকাতা পুলিশের ওই গোয়েন্দাকর্মী। কিন্তু আবাসনের অদূরে কালীপুজোর মণ্ডপের সামনে রিকশা থেকে নামতেই ঘটল বিপত্তি!

স্বপনবাবুর কথায়, ‘‘রিকশাওয়ালাকে বলেছিলাম, মণ্ডপের সামনে একটু দাঁড়ান। ঠাকুর নমস্কার করেই আসছি। কিন্তু দু’মিনিটের মধ্যে মণ্ডপ থেকে বেরিয়ে দেখি রিকশাও নেই, আমার
ব্যাগও নেই।’’

এ দিকে, সোমবার রাতে ফের ডিউটি রয়েছে। কিন্তু বেল্ট, টুপি না থাকায় কী ভাবে কাজে যাবেন, তা নিয়ে রীতিমতো চিন্তায় পড়লেন ওই গোয়েন্দা কর্মী। শেষমেশ একটি অটো ভাড়া করে ডানলপ এলাকায় বিভিন্ন রিকশাচালকের বাড়িতে ঘুরতে শুরু করেন স্বপনবাবু। তিনি বলেন, ‘‘প্রায় ৩৮ বছর ধরে ডানলপ থেকে রিকশা নিয়ে বাড়ি ফিরি। মোটের উপর সব চালককেই চিনি। প্রায় ৩০ জনের বাড়ি ঘুরলাম। কিন্তু ওকে আর পেলাম না।’’


বিশু মণ্ডল

অগত্যা এ দিন সকালে বেলঘরিয়া থানায় ডায়েরি করেন স্বপনবাবু। তার পরে ফের ডানলপ চত্বরে গিয়ে রিকশাচালকের খোঁজ শুরু করেন। তখনই তাঁর সঙ্গে দেখা হয় বাপির। তিনিই ওই অফিসারকে জানান, যে ওই রিকশাচালকের নাম বিশু মণ্ডল। বিকেসি কলেজের উল্টো দিকে ঝিলের এক কোণে কালীমন্দিরের কাছে তাঁর বাড়ি। ঠিকানা খুঁজে সেখানে হাজির হতেই স্বপনবাবু জানতে পারেন, ইতিমধ্যে তাঁর ব্যাগ উদ্ধার করে থানায় নিয়ে গিয়েছে পুলিশ।

অবশেষে বরাহনগর থানায় গিয়ে পরিচয়পত্র জমা দিয়ে নিজের ব্যাগ হাতে নিয়ে হেসে ফেললেন ওই অফিসার, ‘‘কুড়ি বছর গোয়েন্দা দফতরে কাজ করেছি। এত চোর ডাকাত ধরেছি। আর এক জন রিকশা চালককে ধরতে পারব না, ব্যাগ ফেরত পাব কি না— তা নিয়ে চিন্তায় ছিলাম। যাক বাবা, ফেরত তো পেয়েছি!’’

ব্যাগ নিয়েছিলেন যিনি, তা অবশ্য মনেই করতে পারছেন না খোদ বিশু! বরাহনগরের সতীন সেন নগরের বাসিন্দা ওই রিকশাচালককে ধরা গিয়েছিল ডানলপের সোনালি সিনেমা হলের সামনে।

ব্যাগ কোথায়?

প্রশ্নটা শুনে প্রায় আকাশ থেকে পড়ার দশা বিশুর। গলায় ঝোলানো গামছা দু’হাতে আঁকড়ে বললেন, ‘‘মা কালীর দিব্যি স্যার, ব্যাগ কোথায় আমি জানি না। আমি তো কোনও ব্যাগ নিইনি।’’ এর পরে বিশুকে নিয়ে যাওয়া হল ওই ঝিলের পাড়ে। সেখানে গিয়েও বিশুর সেই এক উত্তর।

কিন্তু রবিবার রাতে রিকশায় চড়ে যিনি গিয়েছিলেন তাঁর ব্যাগ কোথায়? বারবার প্রশ্নের ঠেলায় শেষমেশ মনে পড়ল বিশুর। তার পরে খানিক মাথা চুলকে, আমতা আমতা করে বলে ফেললেন, ‘‘রাতে একটু বেশি হয়ে গিয়েছিল। তাই ঝিলের পাড়েই শুয়ে পড়েছিলাম। কিন্তু ব্যাগটা রিকশা থেকে কোথায় গেল, তা তো মনে করতে পারছি না। একটু খুঁজে দেবেন স্যার?’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন