Pond Renovation

সৌন্দর্যায়নের জেরে জলে যাচ্ছে পুকুরের ‘ভবিষ্যৎ’

তাঁরা সঙ্গে সঙ্গে পাড় ভেঙে ফেলার জন্য রাজ্য সরকারের কাছে সুপারিশ করেন। প্রশাসনের তরফে ওই পাড় ভেঙেও ফেলা হয়।

Advertisement

দেবাশিস ঘড়াই

কলকাতা শেষ আপডেট: ১৪ ফেব্রুয়ারি ২০২১ ০৬:৪১
Share:

ফাইল চিত্র।

হঠাৎ করেই জলাশয়ে পর পর কচ্ছপ মারা যেতে শুরু করেছিল। কারণ অনুসন্ধান করতে গিয়ে পরিবেশবিজ্ঞানীরা দেখতে পান, কোচবিচারের ওই জলাশয়ের পাড় বাঁধানো হয়েছে। যার ফলে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে পুকুরের বাস্তুতন্ত্র। মারা যাচ্ছে কচ্ছপ। তাঁরা সঙ্গে সঙ্গে পাড় ভেঙে ফেলার জন্য রাজ্য সরকারের কাছে সুপারিশ করেন। প্রশাসনের তরফে ওই পাড় ভেঙেও ফেলা হয়।

Advertisement

অবৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে পুকুর, জলাশয়ের পাড় বাঁধানো হলে কী ক্ষতি হয়, সে কথা বলতে গেলে এখনও পরিবেশবিজ্ঞানীরা বেশ কয়েক বছর আগের কোচবিহারের ওই ঘটনার কথাই উল্লেখ করেন। আরও একটি পৃথক ঘটনা উঠে আসে আলোচনার বৃত্তে। তা হল, কলকাতা হাইকোর্টে দায়ের হওয়া একটি মামলার পরিপ্রেক্ষিতে ২০০৭ সালের জুনে একটি কমিটি তৈরি করেছিল রাজ্য পরিবেশ দফতর। যার মূল কাজ ছিল পুকুরের পাড় কেমন করে বাঁধানো হবে (‘ডিটারমিনেশন অব দ্য নেচার অব দ্য এমব্যাঙ্কমেন্ট অব ওয়াটার বডিজ়’), তা ঠিক করে দেওয়া। সেই কমিটিতে ছিলেন কলকাতা পুরসভা, কলকাতা মেট্রোপলিটন ডেভেলপমেন্ট অথরিটি, পশ্চিমবঙ্গ জীববৈচিত্র পর্ষদ, রাজ্য দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদ-সহ একাধিক সংস্থার প্রতিনিধি। ওই কমিটি গঠনের তিন মাস পরে, অর্থাৎ ২০০৭-এর সেপ্টেম্বরে নিজেদের রিপোর্ট জমা করে। যার ভিত্তিতে ওই বছরের অক্টোবরে রাজ্য পরিবেশ দফতর একটি নির্দেশিকা জারি করেছিল। সেখানে পুকুর বাঁধানো নিয়ে একগুচ্ছ নিয়ম-বিধির কথা হয়েছিল।

কিন্তু তার প্রায় সাড়ে ১৩ বছর পরে এসে দেখা যাচ্ছে, পরিবেশ দফতরের জারি করা নির্দেশিকা অগ্রাহ্য করেই পুকুর, জলাশয় বাঁধানোর কাজ হয়েই চলেছে। যেখানে জলাশয় সংরক্ষণের থেকে সৌন্দর্যায়নই প্রাধান্য পাচ্ছে বলে জানাচ্ছেন পরিবেশবিদেরা। ফলে পুকুর, জলাশয় ও তার সংলগ্ন এলাকার বাস্তুতন্ত্রের অস্তিত্বে প্রশ্নচিহ্ন উঠে আসছে। রাজ্য প্রশাসন সূত্রের খবর, পুকুর বা জলাশয়ের ঢাল কংক্রিট দিয়ে বাঁধানোর পরিবর্তে তা বাঁশের কাঠামো কিংবা শালবল্লা দিয়ে বাঁধানোর সুপারিশ করেছিল সংশ্লিষ্ট কমিটি। ওই বাঁশের কাঠামো লোহার জালি দিয়ে ঘেরার কথা বলা হয়েছিল। যাতে নুড়িপাথর কোনও ভাবে জলাশয়ে গিয়ে না পড়তে পারে। এমনকি পুকুরের পাড়ও ইট বা দেওয়াল দিয়ে ঘেরা যাবে না।

Advertisement

পরিবেশবিজ্ঞানী তপন সাহার বক্তব্য, ‘‘কারণ, তা হলে তো বৃষ্টির জল যা পুকুরের ধারে পড়ছে, তা সরাসরি পুকুরে যেতে পারবে না। এতে পুকুরের অস্তিত্বই বিপন্ন হয়ে যাবে।’’ অন্য এক পরিবেশবিদ বলছেন, ‘‘শুধু তা-ই নয়, উভচর বা জলচর প্রাণী যাতে অবাধে পাড় থেকে পুকুর, জলাশয় এবং উল্টোপথে যাতায়াত করতে পারে, সেটাও সুনিশ্চিত করা প্রয়োজন।’’ পশ্চিমবঙ্গ জীববৈচিত্র পর্ষদের চেয়ারম্যান অশোককান্তি স্যান্যালের বক্তব্য, ‘‘ওই নির্দেশিকা বার হওয়ার পরেও অনেক ক্ষেত্রেই পুকুরের পাড় বাঁধানো হচ্ছে।’’

কেন নিয়ম-বহির্ভূত ভাবে পুকুর, জলাশয়ের পাড় বাঁধানোর কাজ হয়ে চলছে?

এ প্রশ্নের উত্তরে কলকাতা পুর প্রশাসকমণ্ডলীর সদস্য স্বপন সমাদ্দার বলছেন, ‘‘পুকুর ও জলাশয় সংলগ্ন যে সমস্ত বাড়ি রয়েছে, তার বাসিন্দারাই পাড় বাঁধিয়ে দিতে বলেন। যাতে কোনও ভাবে পাড় সংলগ্ন মাটি ক্ষয় হয়ে বাড়ি না ধসে যায়।’’ যদিও পুর কর্তৃপক্ষের এই যুক্তিকে গুরুত্ব দিতে নারাজ পরিবেশবিদেরা। তাঁদের বক্তব্য, একমাত্র মাটি ক্ষয়িষ্ণু হলে তবেই জরুরি ভিত্তিতে তা বাঁধানো যেতে পারে। সেটা ব্যতিক্রম। এক পরিবেশবিদের কথায়, ‘‘শালবল্লা দিয়ে পাড় বাঁধালেও তা মাটির ক্ষয় রোধ করে। মাটির চরিত্র অনুযায়ী পদক্ষেপ করা প্রয়োজন। কিন্তু শহরে তো গণহারে পুকুর বাঁধানোর কাজ চলছে, যেখানে সৌন্দর্যায়নই মুখ্য, জলে যাচ্ছে পুকুরের ভবিষ্যৎ!’’ নদী বিশেষজ্ঞ সুপ্রতিম কর্মকারের কথায়, ‘‘নিয়ম অনুযায়ী, পুকুরের ঢালে তো বাড়ি থাকার কথাই নয়। ফলে বাড়ি ধসে পড়ে যাওয়ার প্রশ্ন সম্পূর্ণ অর্থহীন।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন