পর্ণশ্রীর কেন্দ্রীয় উদ্বাস্তু কলোনির পাঁচিল ভেঙে অবৈধ নির্মাণ। ছবি: সুমন বল্লভ
পঁচিশ বছর আগের ঘটনারই যেন পুনরাবৃত্তি। তবে রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটের রংটা বদলে গিয়েছে।
আড়াই দশক আগে বেহালার পর্ণশ্রীতে কেন্দ্রীয় সরকারি উদ্বাস্তু আবাসনের ফাঁকা জমি পুরসভার মদতে বেহাত হওয়ার অভিযোগ তুলেছিলেন এলাকার তদানীন্তন সাংসদ মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। প্রতিকার চেয়ে তিনি তখন চিঠি লিখেছিলেন কেন্দ্রকে। এখন আবার একই অভিযোগের তিরে বিদ্ধ কলকাতা পুরসভা। তফাত শুধু একটা জায়গায় তখনকার বিরোধী নেত্রী মমতা এই মুহূর্তে রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী। পরিবর্তনের ঢেউয়ে পুরসভার দখলদারিও বামফ্রন্টের হাত থেকে চলে এসেছে মমতার তৃণমূলের হাতে।
পর্ণশ্রীর উদ্বাস্তু কলোনিটির বাসিন্দাদের একাংশের অভিযোগ, পাঁচিল ভেঙে কলোনির জমিতে অবৈধ ভাবে বহুতল উঠছে। এবং পুরসভা শুধু নীরব দর্শক নয়, তাতে মদতও দিচ্ছে পুর-প্রশাসনের একাংশ। বাসিন্দাদের এ-ও অভিযোগ, বিষয়টি পুরকর্তাদের ও পুলিশকে জানিয়ে লাভ হয়নি, কারণ সংশ্লিষ্ট প্রোমোটারেরা স্থানীয় কাউন্সিলর ও মেয়রের ঘনিষ্ঠ। সুরাহা চেয়ে শেষমেশ কিছু আবাসিক কোর্টে যান। আলিপুর আদালত নির্মাণ বন্ধ রাখার নির্দেশ দেয়। কিন্তু তার তোয়াক্কা করা হয়নি। “সরকারি জমি দখল করে বেআইনি নির্মাণ দিব্যি চলছে। পুর-প্রশাসন ও রাজ্য সরকারের সংশ্লিষ্ট দফতরকে লিখিত ভাবে জানিয়েছি। এখনও কোনও ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।” আক্ষেপ করছেন মামলাকারীদের কৌঁসুলি তাপস সরকার।
বিধি লঙ্ঘন হচ্ছে ঠিক কী ভাবে?
এলাকাবাসীর একাংশের বক্তব্য, গত ফেব্রুয়ারিতে কিছু লোক মিলে কলোনির ৪১ ও ৪৪ নম্বর ব্লকের পাশে পাঁচিল ভেঙে ফেলে। সেখানকার জমিতে নির্মাণ শুরু করেন একাধিক প্রোমোটার। স্থানীয় বাসিন্দারা জানাচ্ছেন, কলোনির পাঁচিল ভেঙে ১১৩এ/১ ও ৩১৫এ উপেন ব্যানার্জি রোডে দুই প্রোমোটার বাড়ি তুলতে শুরু করেছেন। “ওঁরা স্থানীয় কাউন্সিলর ও মেয়রের কাছের লোক। তাই কেউ বাধা দিতে সাহস পাচ্ছে না।” বলছেন ওঁরা। স্থানীয় সূত্রের খবর: নির্মাণস্থলের পাশে বড় রাস্তা নেই। কলোনির পাঁচিল ভেঙে সেই জায়গাটাকে রাস্তা হিসেবে দেখিয়ে ফ্লোর এরিয়া রেশিও (এফএআর)-য় ছাড় নিয়ে বহুতল গড়া হচ্ছে। প্রয়োজনীয় পুর-অনুমোদনও মঞ্জুর হয়ে গিয়েছে বলে পুরসভার বিল্ডিং দফতর সূত্রের খবর।
দেশভাগের পরে মূলত পূর্ব পাকিস্তান থেকে আসা ছিন্নমূল পরিবারগুলির (ইস্ট পাকিস্তান ডিসপ্লেসড্ পারসন, সংক্ষেপে ইপিডিপি) পুনর্বাসনের লক্ষ্যে বেহালায় প্রতিরক্ষা দফতরের ৭৬ একর জায়গা চিহ্নিত করেছিল কেন্দ্র। সেখানে ২৮ একর জুড়ে আবাসন তৈরি হয়, ষাটের দশকের শেষাশেষি যেখানে বসবাস শুরু করেন উদ্বাস্তুরা। এককালীন ১৩ হাজার টাকার বিনিময়ে ফ্ল্যাটগুলির মালিকানা বাসিন্দাদের হাতে তুলে দেওয়ার কেন্দ্রীয় সিদ্ধান্ত হয় ১৯৭৪-এ। সেই মতো ৩২৪টি দু’কামরার ফ্ল্যাটের মালিকানা হস্তান্তর হয়। কেন্দ্রীয় নথিতে এ-ও পরিষ্কার বলা আছে, কলোনির ফাঁকা জমি কেউ কোনও ভাবে দখল করতে পারবে না। জমি ব্যবহার করতে হবে আবাসিকদের কল্যাণেই। পুরো এলাকা পাঁচিলে ঘিরেও দেওয়া হয়।
সরকারি সূত্রে জানা যাচ্ছে, আশির দশকের গোড়ায় কলোনিতে জল সরবরাহ, নিকাশি ও বর্জ্য নিষ্কাশনের ভার কেন্দ্রীয় সরকার তুলে দেয় তৎকালীন সাউথ সাবার্বান মিউনিসিপ্যালিটি’কে। পরিষেবার খরচ বাবদ ৬ লক্ষ ৮৫ হাজার টাকা অনুদানও পায় পুরসভা। সেই সঙ্গে পরিষেবার কাজ দেখভালের জন্য কলোনির চারটি ফ্ল্যাট, জমি সমেত। এখনকার পর্ণশ্রী থানা ওই জমিতেই গড়ে উঠেছে। আশির দশকের মাঝামাঝি নাগাদ সাউথ সাবার্বান মিউনিসিপ্যালিটি মিশে যায় কলকাতা পুরসভায়। ইতিমধ্যে উদ্বাস্তু কলোনির জমি দখলের প্রবণতা মাথা চাড়া দিয়েছে। বস্তুত ১৯৮৪-র অক্টোবরেই বিষয়টি তদানীন্তন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গাঁধীর গোচরে আনা হয়েছিল। তৎকালীন রাজ্যসভা সদস্য অরবিন্দ ঘোষকে চিঠি লিখে ইন্দিরা জানিয়েছিলেন, ব্যাপারটা দেখার জন্য কেন্দ্রের তরফে এক জন ‘এস্টেট অফিসার’ নিয়োগ করা হচ্ছে। ঘটনাচক্রে ’৮৪-র অক্টোবরেই ইন্দিরা নিহত হন। এর পরে, ১৯৮৮-তে তদানীন্তন যাদবপুর লোকসভা কেন্দ্রের সাংসদ (এলাকাটি তখন যার আওতায় ছিল) মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় উদ্বাস্তু কলোনির জমি দখল নিয়ে সরব হন। প্রতিকার চেয়ে তৎকালীন কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী চিন্তামণি পাণিগ্রাহিকে চিঠিও লেখেন তিনি।
আর এ বার জমি দখলের জন্য আঙুল উঠেছে সেই মমতারই দলের নেতা-জনপ্রতিনিধিদের দিকে। বাসিন্দাদের একাংশের দাবি, কাউন্সিলরকে তাঁরা জানিয়েছিলেন এটা কেন্দ্রীয় সরকারের জমি, এখানে এ ভাবে বাড়ি তোলা যায় না। কিন্তু কাউন্সিলর তা কানেই তোলেননি। এক আবাসিকের কথায়, “উল্টে উনি বললেন, পুরসভার জমি নিয়ে আপনারা বলার কে?” সংশ্লিষ্ট ১৩২ নম্বর ওয়ার্ডের সেই তৃণমূল কাউন্সিলর সঞ্চিতা মিত্র অবশ্য এ সব মানতে চাননি। “এমন কিছু আমি জানি না। কেউ আমায় অভিযোগও করেনি।” দাবি করেছেন তিনি। প্রোমোটারকে বেআইনি নির্মাণে মদতদানের অভিযোগ উড়িয়ে দিয়েছেন মেয়র শোভন চট্টোপাধ্যায়ও। বলেছেন, “কে কোথায় বিল্ডিং করছে, আমার জানা নেই।” তবে ওই কলোনির ফাঁকা জমির উপরে আবাসিকদের এক্তিয়ার আছে বলে মেয়র মনে করেন না। “উদ্বাস্তু কলোনির ফ্ল্যাটের বাসিন্দাদের অধিকার শুধু ফ্ল্যাটের মধ্যেই সীমাবদ্ধ। কলোনির ফাঁকা জমির উপরে নয়।” মন্তব্য তাঁর। কলোনির বেশ কিছু লোক অবৈধ ভাবে নিজের নিজের ফ্ল্যাটের পরিধি বাড়িয়ে নিয়েছেন এই অভিযোগ তুলে শোভনবাবুর পাল্টা হুঁশিয়ারি, “কলোনির রাস্তা, নিকাশি, জল সরবরাহ, সব আমাদের হাতে। এটা ওঁদের মনে রাখা দরকার।” প্রসঙ্গত, মহিলা প্রার্থীর জন্য সংরক্ষিত হওয়ার আগে, ২০১০ পর্যন্ত শোভনবাবুই ছিলেন ১৩২ নম্বর ওয়ার্ডে নির্বাচিত কাউন্সিলর।
কলোনির সিংহভাগ আবাসিক যদিও ভিন্নমত। অম্লান সেনগুপ্ত, তপোময় চক্রবর্তী, সৌমিত্র চক্রবর্তী, কমল মিত্র বা শুভাশিস বক্সিদের বক্তব্য: কেন্দ্রীয় নির্দেশিকায় পরিষ্কার বলা হয়েছিল, জমি ব্যবহার করা যেতে পারে শুধুমাত্র কলোনির বাসিন্দাদের প্রয়োজনে। “পুর প্রশাসন এটা কেন অস্বীকার করছেন?’’ প্রশ্ন ওঁদের। রাজ্য সরকারই বা কেন হাত গুটিয়ে রয়েছে, তা-ও ওঁরা বুঝতে পারছেন না। বর্তমানে কলোনি দেখভালের দায়িত্ব যাদের, রাজ্যের সেই উদ্বাস্তু ত্রাণ ও পুনর্বাসন দফতরে চিঠি লিখেও কোনও লাভ হয়নি বলে তাঁরা জানিয়েছেন। ঘটনা শুনে রাজ্যের ত্রাণ ও পুনর্বাসনমন্ত্রী মঞ্জুলকৃষ্ণ ঠাকুরের আশ্বাস, “অফিসারদের খোঁজ নিতে বলব।”
কলোনিবাসী অবশ্য জানিয়েছেন, গত মে মাসে দফতরের অ্যাসিস্ট্যান্ট সেক্রেটারি উপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য এক অধিকর্তাকে নির্দেশ দিয়েছিলেন। তাতেও কিছু হয়নি।