সানশাইন কাটিয়ে ঝলমল পসরা

হাতিবাগানে সুযোগ নেই ফুটপাথ দিয়ে হাঁটার। প্রায় গোটা চত্বর জুড়েই সেখানে রকমারি জিনিসের বিকিকিনি। ফুটপাথ আর রাস্তা দখলের ছবিটা ধর্মতলা চত্বরেও সমান ভয়াবহ। যে যেমন পেরেছেন, বসে পড়েছেন ফুটপাথ আগলে।

Advertisement

জয়তী রাহা

শেষ আপডেট: ১৫ ডিসেম্বর ২০১৭ ০২:৪৯
Share:

 এখন-তখন: হকারদের ভিড়ে পা ফেলার জায়গা নেই ফুটপাথে। হাতিবাগান ও নিউ মার্কেটে।

গয়না, জামাকাপড়, ব্যাগের ভিড়ে হারিয়ে যায় চলার পথ। মোটা প্লাস্টিকের ছাউনিতে সেখানে ঢাকা পড়ে আকাশ। দমবন্ধ করা ভিড়ে চলে ক্লান্ত ক্রেতাদের ধাক্কাধাক্কি। ধুলোমাখা বাঁশ-প্লাস্টিকের কাঠামোর দখলে চলে যাওয়া ফুটপাথ দিয়ে সাধারণ পথচারীর হাঁটাচলা কার্যত নিষিদ্ধ। বৃহস্পতিবার গোটা কলকাতা ঘুরে দেখা গেল শ্যামবাজার থেকে হাতিবাগান, গড়িয়াহাট, ধর্মতলা চত্বরের ছবিটা একই রকম।

Advertisement

এ চিত্র বদলানোর চেষ্টা হয়েছিল ১৯৯৬ সালে। গত মঙ্গলবার রাতের করুণাময়ীর মতো এক রাতে হাতিবাগান-গড়িয়াহাটের ফুটপাথে চলেছিল বুলডোজার, পে-লোডার। ভেঙে গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল ফুটপাথের ধারের সব দোকানের কাঠামো। কলকাতার ইতিহাসে যা ‘অপারেশন সানশাইন’ নামে পরিচিত। সে দিনের পরে ফাঁকা ফুটপাথ দেখেছিল বটে শহরবাসী, ফের বদলেছে পরিস্থিতি। এ শহরের হকার-চিত্র ফিরেছে নিজের ছন্দে।

হাতিবাগানে সুযোগ নেই ফুটপাথ দিয়ে হাঁটার। প্রায় গোটা চত্বর জুড়েই সেখানে রকমারি জিনিসের বিকিকিনি। ফুটপাথ আর রাস্তা দখলের ছবিটা ধর্মতলা চত্বরেও সমান ভয়াবহ। যে যেমন পেরেছেন, বসে পড়েছেন ফুটপাথ আগলে। ‘‘এখানে জোর যার মুলুক তার,’’ বললেন ওই এলাকার এক হকার, সামসুদ্দিন। জানালেন, প্রায় তিরিশ বছর ধরে এ ভাবে এই চত্বরের ফুটপাথে ব্যবসা করছেন তিনি। প্রথমে ছিলেন মেট্রো সিনেমার সামনে। এখন হগ মার্কেটের কাছেই রয়েছে তাঁর দোকান। বছর পাঁচেক আগেও এমন পরিস্থিতি ছিল না বলে তাঁর দাবি। রাস্তা বলে কোনও ছাড় নেই। হগ মার্কেটের সামনে, গ্র্যান্ড হোটেলের নীচে, শপিং মলের সামনে, গাড়ি রাখার জায়গা— সর্বত্রই এখন হকারের ভিড়। কলকাতা পুরসভার নাকের ডগার এই ছবিটা অবশ্য দেখেও দেখছেন না পুর আধিকারিক বা পুর প্রতিনিধিরা। তাঁদের দাবি, ‘অপারেশন সানশাইন’-এর আগেও যেমন চলছিল, তার পরেও তেমনই চলছে। তা ছাড়া, পুরসভার পক্ষে নিজে থেকে হকার নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব নয়। নির্দিষ্ট অভিযোগ জমা পড়লে দেখা যেতে পারে বলে দাবি তাঁদের। হকার্স সংগ্রাম কমিটির যুগ্ম সচিব অনাদি সাহার হাতে ধর্মতলা চত্বরের হকারদের শাসনভার অনেকটাই। তিনি জানান, প্রায় হাজার খানেক হকার এই কমিটির অধীনে। রয়েছে ফরওয়ার্ড ব্লক, সিপিএম ও তৃণমূলের ইউনিয়নও। দিন দিন সংখ্যাটা যে বেড়েই চলেছে, তা মানছেন তিনি।

Advertisement

ফুটপাথ-বাজারের আরও এক প্রাণকেন্দ্র গড়িয়াহাট। এই বাজারে ‘অপারেশন সানশাইন’ ছিল তখন খবরের শিরোনামে। সেখানেও ১৯৯৬ সালে চলেছিল অভিযান। ভেঙে ফেলা হয়েছিল সব। এক দিনে সুনসান হয়ে গিয়েছিল গড়িয়াহাটের ফুটপাথ। তবে হকারেরা দমে যাননি। বর্তমানে ফের চওড়া ফুটপাথের উপরে সার দিয়ে পসরা নিয়ে হাজির তাঁরা। হাতিবাগানের মতো একেবারে দখল না হলেও, হার-দুল-ব্যাগ-জুতোর ভিড়ে ঢাকা পড়েছে ফুটপাথের অধিকাংশটাই। ‘অপারেশন সানশাইন’-এর পরে এক মাসব্যাপী হকারদের মিছিল, মিটিং চলেছিল। পাশে ছিলেন তৎকালীন বিরোধী নেত্রী বর্তমান মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। এক মাস ধরে মানব বন্ধনের কায়দায় পুলিশ ব্যারিকেড করা হয়েছিল সে সময়ে, মনে করালেন সংগ্রাম কমিটির সহ-সভাপতি অভিজিৎ সাহা। রোজগার ছিনিয়ে নেওয়ার প্রশ্নে রাজনৈতিক বিতর্ক সে সময়ে গড়িয়েছিল অনেক দূর। কিছু বিতর্ক টিঁকে আছে আজও। ‘অপারেশন সানশাইনে’-এর সময়ে বড় ভূমিকায় থাকা তৎকালীন কলকাতা পুরসভার মেয়র পারিষদ (সলিড ওয়েস্ট ম্যানেজমেন্ট) কান্তি গঙ্গোপাধ্যায়ের মত, শহরটা হকারমুক্ত করা ওই অভিযানের উদ্দেশ্য ছিল না। শুধু ২১টি বড় রাস্তা থেকে হকার সরাতে হয়েছিল অভিযান। তিনি বলেন, ‘‘পরিবর্তে হকারদের পুনর্বাসন দেওয়া হয়েছিল। অন্য রাস্তাগুলিতে কাঠামো ছাড়া, এক তৃতীয়াংশ ফুটপাথে বসার কথা ছিল। কিন্তু প্রবল বিরোধিতায় সে সব ভেস্তে গেল।’’ শেষে ২০০০ সালে সুব্রত মুখোপাধ্যায় মেয়র হওয়ার পরে বদলে যায় পরিস্থিতি। শহরের হকার-চিত্র ফিরে আসে একই উদ্যমে। সেখানেও দিন দিন বেড়ে চলেছে ফুটপাথ আগলে ব্যবসার ভিড়।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন