গনগনে রোদে ঘণ্টার পর ঘণ্টা বাস চালাতে হয় সমীর হাজরাকে। রাতেও রেহাই নেই। সূর্যের তাপ কমলেও ইঞ্জিনের গরম কমে না। দিনে প্রায় ১২-১৪ ঘণ্টা এই হাড়ভাঙা পরিশ্রমের পরেও নিশ্চিত বেতন পাওয়ার সুযোগ নেই। মাইনে নির্ভর করে যাত্রী সংখ্যার উপরে। টিকিট বিক্রি হলে তার কমিশনের ভিত্তিতে আয় হবে বেশি। না হলে পকেট ফাঁকা। কোনও রকমে দিনের শেষে ভাত-ডালটুকু জুটবে কি না, তা নিয়ে সাত-পাঁচ ভাবতে থাকেন সমীর। এমনই অবস্থা তাঁর অনেক চালক-বন্ধু, বাস কন্ডাক্টর এবং তাঁদের সহকারীদেরও।
অগত্যা তাই এ বার বাস ছেড়ে ওলা-উবেরে গাড়ি চালানোর দিকে ঝুঁকছেন সমীর হাজরার মতো বাসের সঙ্গে যুক্ত শ্রমিকদের একাংশ। লজ্ঝড়ে বাস চালিয়ে গলদঘর্ম হয়েও দিনে হাজারখানেক টাকার বেশি রোজগার হয় না। অথচ, দিনে ১২ ঘণ্টা ওলা-উবেরে গাড়ি চালিয়ে মাসে ১৫ হাজার টাকা রোজগার বাঁধা। সঙ্গে উপরিও আছে।
এ রাজ্যে বেসরকারি বাস চালু হওয়ার সময় থেকেই কন্ডাক্টর-চালকদের দৈনিক বেতন দেওয়া হয় কমিশনের ভিত্তিতে। বাসমালিকদের একাংশের মতে, অতীতে কমিশনের ভিত্তিতে বেতন হওয়ায় চালকদের লাভ ছিল ভালই। কিন্তু যত দিন গিয়েছে, অন্যান্য যাতায়াতের মাধ্যম চলে আসায় বাসের যাত্রী সংখ্যা কমেছে। তার সঙ্গে তাল মিলিয়ে কমেছে কমিশনের পরিমাণও। পাশাপাশি যাত্রীদের একাংশের দাবি, কমিশন বাড়াতেই বিভিন্ন সময়ে দু’টি বাসের রেষারেষি চলে। যার ফলাফল অনেক সময়েই মারাত্মক দুর্ঘটনায় ঘটে। কিন্তু বাসমালিকেরা এই কমিশনের ভাবনা থেকে বেরিয়ে আসতে না পারার কারণেই ক্রমশ কমছে চালকের সংখ্যা। কলকাতা শহরে ওলা-উবেরের মতো লাক্সারি ট্যাক্সির বাড়বাড়ন্তে ইতিমধ্যেই অনেক ট্যাক্সিচালক পেশাবদল করে ওই সব গাড়ি চালাচ্ছেন। এ বার সেই দিকে ঝুঁকছেন বাসের চালকেরাও।
তার জেরে ফল কী দাঁড়াচ্ছে?
চালকের অভাবে কলকাতা ও লাগোয়া এলাকায় অনেক বাসমালিক রাস্তায় বাসই নামাতে পারছেন না। ঠারেঠোরে সে কথা স্বীকার করে নিচ্ছেন কমবেশি সব বাসমালিকই। বেসরকারি বাসমালিকদের সংগঠন বেঙ্গল বাস সিন্ডিকেটের নেতা দীপক সরকার বলেন, ‘‘কলকাতা ও শহরতলিতে আমাদের মোট চার হাজার বাস চলে। তার মধ্যে প্রায় এক হাজারেরও বেশি বাস চালানো যাচ্ছে না। কারণ, চালক ও কন্ডাক্টরই নেই। বাস চালাবে কে?’’ একই বক্তব্য মিনিবাস অপারেটর্স কো-অর্ডিনেশন কমিটির নেতা অবশেষ দাঁ-রও। তিনি বলেন, ‘‘তিন হাজারের মধ্যে মাত্র ছ’শোর বেশি বাস চালানো যাচ্ছে না। কারণ চালক নেই।’’ আর এক বাসমালিক সংগঠন ‘জয়েন্ট কাউন্সিল অব বাস সিন্ডিকেট্স’-এর নেতা তপন বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, ‘‘কলকাতা, হাওড়া ও দুই ২৪ পরগনায় আমাদের সংগঠনের আওতায় প্রায় আট হাজার বাস চলে। কিন্তু চালকের অভাবে ছ’হাজারের বেশি বাস চালানো যাচ্ছে না।’’
তবে কমিশনের জন্য চালক-কন্ডাক্টরদের আকাল চলছে— এমনটাও মানতে নারাজ বাসমালিকদের একাংশ। ‘বেঙ্গল বাস সিন্ডিকেট’-এর নেতা দীপকবাবুর বক্তব্য, ‘‘শুধু জ্বালানির দাম কমা দেখেই সরকার বাসের ভাড়া ঠিক করে। অথচ, জ্বালানি ছাড়া অন্য খরচ তো দিন দিন বেড়েই চলছে। সেটা সরকার দেখছেই না। পাশাপাশি, পুলিশি জুলুমে হয়রান বাসচালকেরা। তার মাসুলও দিতে হচ্ছে। পুলিশি জুলুমে অতিষ্ঠ হয়ে বাস চালানো ছেড়ে ওলা-উবেরের দিকে ঝুঁকছেন অনেক চালকই।’’ দীপকবাবুর ব্যাখ্যা, আগেও এই সমস্যা ছিল, কিন্তু চালকদের যাওয়ার জায়গা ছিল না। এখন আছে, তাই বাসের কাজ ছেড়ে দিচ্ছেন অনেকেই।
সরকারকেই এই সমস্যা সমাধানের দায় নিতে হবে বলে মনে করেন বাস-মালিকেরা। দীপকবাবু, তপনবাবুদের মতে, বাস কমে গেলে তো জনসাধারণের ক্ষতি। যাতায়াতে অনেক বেশি গাঁটের ক়়ড়ি খরচ করতে হবে। ট্যাক্সির হাল ফেরাতে গাড়ির সংখ্যাও বাড়বে হু-হু করে। তবে তাতে বাসচালকের আকাল আরও বাড়বে— মানছেন সব অংশের বাসমালিকেরাই।
আর সরকার? পরিবহণ দফতরের এক কর্তা বলেন, ‘‘এখন তো বাসের ভাড়া পর্যাপ্ত। বৃদ্ধির প্রশ্নই ওঠে না। তা ছাড়া, সরকার বাসভাড়া বৃদ্ধি বা হ্রাসের জন্য একটি পৃথক কমিশন গঠন করেছে। অন্যান্য খরচ কতটা কী বেড়েছে, তা হিসেব করে ভাড়া বৃদ্ধির সিদ্ধান্ত নেবে কমিশনই।