মত্ত ক্রেতাকে নিরাপত্তা দিয়ে ওঁরাই যেন দুর্গা

দক্ষিণ কলকাতার শেক্সপিয়র সরণির ছ’তলার এক পাবের দরজায় দেখা মিলবে তাঁর। সমবয়সি সঙ্গী তরুণীরও এক পোশাক, এক রকম চেহারার গঠন।

Advertisement

দীক্ষা ভুঁইয়া

কলকাতা শেষ আপডেট: ০৯ ডিসেম্বর ২০১৯ ০২:৫৫
Share:

ভরসা: শেক্সপিয়র সরণির একটি পাবে পুরুষদের পাশাপাশি দায়িত্ব সামলানো মহিলা বাউন্সারেরাও। নিজস্ব চিত্র

বলিষ্ঠ চেহারা। পরনে কালো রঙের ট্রাউজার্স আর টি-শার্ট। চকচকে কালো জুতো। টেনে উঁচু করে বাঁধা চুল। বছর তেইশের ক্লান্তিহীন তরুণীটি সকলকে হাসিমুখে অভ্যর্থনা জানিয়ে চলেছেন। সন্ধ্যা ছ’টা থেকে রাত বারোটা-একটা পর্যন্ত এক ভাবেই চলে তাঁর এ কাজ।

Advertisement

দক্ষিণ কলকাতার শেক্সপিয়র সরণির ছ’তলার এক পাবের দরজায় দেখা মিলবে তাঁর। সমবয়সি সঙ্গী তরুণীরও এক পোশাক, এক রকম চেহারার গঠন। পাবে আসা তরুণীদের দিকেই নজর ঘোরে ওঁদের। কারণ, এঁরা ‘বাউন্সার’! যাঁদের ইউএসপি— বলিষ্ঠ চেহারা ও উপস্থিত বুদ্ধি। তবে এই চেহারা দেখে চাকরি মিললেও তা কিন্তু শুধুই প্রদর্শনের জন্য। তাই নিরাপত্তার জন্য ঠায় দরজায় দাঁড়িয়ে থাকলেও, এঁদের স্থির লক্ষ্য পাব বা নাইটক্লাবে মত্ত অবস্থায় থাকা মহিলা বা পুরুষদের ক্ষোভ ঠান্ডা মাথায় সামলানো। কারণ, ওঁদের কথায়, ‘‘ক্রেতা হলেন অতিথি। তাঁরাই না এলে বেতনের টাকা আসবে কোথা থেকে?’’

মুম্বই, দিল্লির পাব কিংবা নাইটক্লাবে ‘বাউন্সার’ হিসেবে মহিলাদের প্রবেশ অনেক আগে ঘটলেও, বছর দশেক হল ওঁদের দেখা মিলেছে কলকাতায়। এখন তো রীতিমতো পুরুষদের সঙ্গে এই পেশায় পাল্লা দিতে শুরু করেছেন ওঁরা। এক সময়ে পানশালা, পাব কিংবা নাইটক্লাবে মহিলাদের প্রবেশকে বাঁকা চোখে দেখত সমাজ। তাই সেখানে মহিলা ক্রেতা বিশেষ নজরে পড়ত না। ফলে মত্ত মহিলা ক্রেতা সামলানোর কথাও ভাবেনি এ শহর। বদলেছে দিন। মত্ত অবস্থায় উত্তেজিত হয়ে ওঠা পুরুষদের পাশাপাশি মহিলাদের সামলানোর কথা তাই ভেবেছে সাবালক কলকাতা।

Advertisement

এমনকি কেউ বেসামাল হয়ে অসুস্থবোধ করলে তাঁর পরিচর্যাতেও ওঁরাই এগিয়ে আসেন। ভিড় থেকে সন্তর্পণে সরিয়ে এনে লেবুজল খাইয়ে ক্রেতাকে সুস্থ করে তোলা তাঁদের পরবর্তী কাজ। তখন ঠিক যেন পরিবারের মেয়েটি। এর পরে তাঁকে নিশ্চিন্ত ঠিকানায় পৌঁছে দেওয়ার পালা। সে দায়িত্বও দক্ষতার সঙ্গে সামলে নেন মহিলা বাউন্সারেরা।

এ সব কারণেই ওঁদের কাজে নিতে স্বস্তি বোধ করেন পানশালা মালিক এবং ম্যানেজারেরা। তাঁদের কথায়, অপ্রীতিকর পরিস্থিতি সামলাতে গিয়ে এক জন পুরুষ বাউন্সারের হাত কোনও ভাবে মহিলা ক্রেতার গায়ে লাগলে যৌন হেনস্থার অভিযোগ ওঠার আশঙ্কা থাকে। কিন্তু মহিলা বাউন্সার পুরুষ অথবা মহিলা দু’ধরনের ক্রেতাকেই সামলাতে পারেন। তাই এ কাজে এখন মহিলাদের কদর যে বেশি মানছেন ওঁরা।

মহিলা বাউন্সারদের দৈনিক আয় ৪০০-৪৫০ টাকা। বলিষ্ঠ চেহারা আর উপস্থিত বুদ্ধিকে সম্বল করে বছর তেইশের যুবতী গীত রহমান (নাম পরিবর্তিত) বেছে নিয়েছেন এই পেশা। ছ’বছরের মেয়েকে পড়াশোনা শিখিয়ে জীবনে প্রতিষ্ঠিত করাই গীতের লক্ষ্য। দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত পড়ে তাঁকে ছাড়তে হয়েছিল পড়াশোনা। মেয়ে হওয়ায় স্বামীও ছেড়ে গিয়েছেন। তাই একাই শিশুকন্যার দায়িত্ব নিজের কাঁধে তুলে নিয়েছেন গীত। তাঁর কথায়, ‘‘এই শিক্ষাগত যোগ্যতায় এমন বেতনের চাকরি আর কোথায় পাব?’’ বাইরের মানুষ কী চোখে বাউন্সারদের দেখেন, তা নিয়ে গীতের ভাবনা নেই। কারণ, নিজের পেশাকে সম্মান করেন তিনি। গীতের বাবা, মা-ও জানেন যে তিনি বাউন্সার। এটাই তাঁর কাছে যথেষ্ট।

একই বক্তব্য তাঁর সঙ্গী বেহালার ঈশা শর্মার (নাম পরিবর্তিত)। আদতে বিহারের হলেও জন্মসূত্রে বেহালার বাসিন্দা ঈশার স্বামীও জানেন স্ত্রী পাবের বাউন্সার। গোচারণের বাসিন্দা কাকলি দাসও এই পেশায় এসেছেন সম্মান এবং টাকার জন্য। কাকলির প্রশ্ন, ‘‘অন্য পেশায় কে দেবে এই টাকা? তা ছাড়া এখানে তো আমি অন্যদের নিরাপত্তা দিচ্ছি। তা হলে খারাপটা কোথায়?’’

শুধু ক্লাব, পানশালা কিংবা পাব নয়। তথ্য বলছে, নব্বই দশকের গোড়া থেকে শহরের বুকে বড় বড় ‘ইভেন্ট’ সামলাতেও মহিলা বাউন্সারদের চাহিদা শুরু হয়েছিল। আর এখন তো নিজের নিরাপত্তাতেও তারকারা পুরুষের পাশাপাশি চাইছেন মহিলা বাউন্সারদের!

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন