Dengue

এত দিন কোথায় ছিলেন, প্রশ্নের মুখে পুরকর্মীরা

বাড়ির পিছনে বা গলির ভিতরের অন্ধকারে জমে থাকা জলে ডেঙ্গির মশা বংশবিস্তার করছে কি না, সেটাই খুঁজতে বেরিয়েছেন তাঁরা। এমনকী, কারও জ্বর হয়েছে বলে খবর পেলে তা-ও খাতায় নোট করে নিচ্ছেন।

Advertisement

আর্যভট্ট খান

শেষ আপডেট: ১২ নভেম্বর ২০১৭ ০০:২৬
Share:

আতঙ্ক: পুতুল নিয়ে পথনাটিকাতেও এ বার উঠে এল ডেঙ্গি। শনিবার, কলেজ স্কোয়ারে।

হাতে টর্চ নিয়ে লেকটাউনের এস কে দেব রোড সংলগ্ন পল্লিশ্রী কলোনিতে ঘুরে বেড়াচ্ছিলেন দুই মধ্যবয়স্ক মহিলা। তখনও সন্ধ্যা নামেনি। রাস্তায় পর্যাপ্ত আলোও রয়েছে। তা হলে হাতে টর্চ কেন? প্রশ্ন করতে জানা গেল, ওঁরা দু’জন দক্ষিণ দমদম পুরসভার কর্মী। সরস্বতী দাস ও চন্দনা পাল নামে ওই দুই মহিলা টর্চ নিয়ে জমা জল আর চৌবাচ্চা খুঁজতে বেরিয়েছেন। বাড়ির পিছনে বা গলির ভিতরের অন্ধকারে জমে থাকা জলে ডেঙ্গির মশা বংশবিস্তার করছে কি না, সেটাই খুঁজতে বেরিয়েছেন তাঁরা। এমনকী, কারও জ্বর হয়েছে বলে খবর পেলে তা-ও খাতায় নোট করে নিচ্ছেন।

Advertisement

ঘুরতে ঘুরতে তাঁরা সটান ঢুকে পড়লেন একটি বাড়ির পিছনের বাগানে। ঢুকতেই ওই বাড়ির এক মহিলা বলে উঠলেন, ‘‘এত দিনে এলেন মশার লার্ভা খুঁজতে? চৌবাচ্চা পরীক্ষা করতে? পরের বছর আসুন। এ বছর আমরা নিজেরাই সব সাফ করে দিয়েছি। আপনাদের আসতে অনেক দেরি হয়ে গিয়েছে।’’

লেকটাউনের এস কে দেব রোডে একটি ট্যাবলোয় একদল লোক গান গেয়ে বোঝাচ্ছিলেন, ডেঙ্গির হাত থেকে বাঁচতে কী কী করতে হবে। গানের মাধ্যমে বলা হচ্ছিল, ঘরে জল জমিয়ে রাখবেন না। জঞ্জাল জমাবেন না। শুনে পাড়ার লোকেদের টিপন্নি, ‘‘এত দেরিতে ঘুম ভাঙল আপনাদের? এই গানটাই যদি মাস কয়েক আগে গাইতেন, তা হলে হয়তো ঘরে ঘরে মানুষ ডেঙ্গির কবলে পড়ত না। এত মানুষ দক্ষিণ দমদম পুর এলাকায় মারাও যেত না।’’

Advertisement

জমা জল এবং আবর্জনার স্তূপ দক্ষিণ দমদমের পল্লিশ্রী এলাকায়। ছবি: সুমন বল্লভ

দক্ষিণ দমদম পুরসভার এস কে দেব রোড এলাকার বাসিন্দারা এখন ক্ষোভে ফুটছেন। তাই পুরসভার ডেঙ্গি-বিরোধী কোনও উদ্যোগ দেখলেই ব্যঙ্গ-বিদ্রুপ শুরু করছেন তাঁরা। রসিক লোকজন আবার জীবনানন্দ দাসের কবিতা উদ্ধৃত করে বলছেন, ‘‘এত দিন কোথায় ছিলেন?’’ এলাকার বাসিন্দাদের মতে, পুরসভা ঠিক সময়ে ডেঙ্গি-বিরোধী অভিযানে নামলে এমন ভয়াবহ অবস্থা হত না। পল্লিশ্রী এলাকার বাসিন্দা সপ্তর্ষি রায় বলেন, ‘‘এখনও ঘরে ঘরে জ্বর। আমরা আতঙ্কে নিজেরাই মশার তেল কিনে নর্দমায় ছড়িয়েছি। ডেঙ্গির যখন আরও বা়ড়বাড়ন্ত ছিল, তখন কাউকে দেখা যায়নি। এখন প্রকোপ কমার সময়ে পুরসভা কোমর বেঁধে নেমেছে।’’

তবে কোমর বেঁধে নামলেও এখনও এলাকার বেশ কয়েকটি ক্ষতস্থান ঢাকতে পারেনি পুরসভা। যেমন, এস কে দেব রোডের এক নম্বর পল্লিশ্রীর ঝিল। ওই ঝিলের নোংরা জল কিছুটা পরিষ্কার করা হয়েছে। তবু বেশ কয়েকটি জায়গায় এখনও জল জমে রয়েছে। যা ডেঙ্গির লার্ভা জন্মানোর জন্য আদর্শ। ওই ঝিলের পাশেই রয়েছে বেশ কয়েকটি বাড়ি। এমনই একটি বাড়ির বাসিন্দা অনিতা দাস বলেন, ‘‘ওই ঝিলটা অর্ধেক সাফ করেই চলে গেলেন পুরকর্মীরা। কাজের কাজ কিছুই হল না। সন্ধ্যা থেকেই প্রচুর মশা ঘরে ঢুকে পড়ছে। মশা মারার ধূপ জ্বালিয়েও কোনও লাভ হয় না। এই ঝিলটা পুরোপুরি পরিষ্কার কবে হবে?’’

এলাকাবাসীর মতে, দক্ষিণ দমদম পুরসভার আর এক ক্ষতস্থানের নাম নর্দমা। পুরসভার উদ্যোগে বেশ কিছু এলাকার নর্দমা এখন আর খোলা নয়। সিমেন্ট দিয়ে ঢেকে দেওয়া হয়েছে। কিন্তু অভিযোগ, সমস্ত নর্দমা সিমেন্ট দিয়ে ঢেকে দেওয়ার কাজ শেষ করে উঠতে পারেনি পুরসভা। সেই সঙ্গে নর্দমাও পরিষ্কার হয়নি বলে অভিযোগ। ফলে যে সব জায়গা ফাঁকা, সেগুলি মশার আঁতুড়ঘর হয়ে গিয়েছে।

এলাকার মানুষ সম্প্রতি খবরের কাগজ পড়ে জানতে পেরেছেন, শ্রীরামপুর পুরসভা কী ভাবে গত বারের ডেঙ্গি থেকে শিক্ষা নিয়ে এ বছর অনেক আগে থেকেই কোমর বেঁধে নেমে ডেঙ্গির মোকাবিলা করেছে। ওই কাজে তারা এ বার ফ্রেব্রুয়ারি মাস থেকেই বাড়ি বাড়ি প্রচার শুরু করেছে। মশা মারার তেল ছড়িয়েছে। ব্লিচিংও ছড়ানো হয়েছে। আর হাতেনাতে তার ফলও মিলেছে। শ্রীরামপুর পুর এলাকায় মাত্র ৪০ থেকে ৫০ জন ডেঙ্গিতে আক্রান্ত হয়েছিলেন, যাঁদের প্রায় সকলেই সুস্থ হয়ে গিয়েছেন। পাতিপুকুর এলাকার বাসিন্দাদের প্রশ্ন, শ্রীরামপুর পুরসভা যদি পারে, তা হলে তাঁদের পুরসভা পারবে না কেন? শ্রীরামপুর মডেল অনুসরণ করুক দক্ষিণ দমদম পুরসভা। ডেঙ্গি মহামারির আকার ধারণ করার পরে সচেতন হয়ে কোনও লাভ নেই। বরং এলাকা পরিষ্কার করা থেকে শুরু করে ব্লিচিং ও মশার তেল ছড়ানোর কাজ নিয়মিত ভাবে শুরু হোক ফেব্রুয়ারি মাস থেকেই।

স্থানীয় বাসিন্দাদের অভিযোগ, পুরসভার এত দিনের গা-ছাড়া মনোভাবের জন্যই এ বছর দক্ষিণ দমদম পুর এলাকায় ডেঙ্গি এতটা লাগামছাড়া। তাঁদের দাবি, এ বছর দক্ষিণ দমদম পুর এলাকাতেই মৃত্যুর সংখ্যা অন্তত কুড়ি ছাড়িয়েছে। যদিও পুর চেয়ারম্যানের দাবি, তাঁর পুরসভা এলাকায় মাত্র চার জন ডেঙ্গিতে মারা গিয়েছেন। তার মধ্যে তিন জন আবার বাইরে থেকে আসা রোগী। চেয়ারম্যান বলেন, ‘‘আমরাও মার্চ-এপ্রিল থেকে ডেঙ্গি-বিরোধী অভিযান চালু করেছিলাম। রক্ত পরীক্ষার কাজ করা হচ্ছে বেশ কয়েক মাস ধরে। স্বাস্থ্য শিবির করা হয়েছে নিয়মিত। মশাবাহিত রোগ প্রতিরোধে এ বছর ইতিমধ্যেই পুরসভা দু’কোটি টাকা খরচ করেছে।’’

এলাকাবাসীর প্রশ্ন, দু’কোটি টাকা খরচ করেও ডেঙ্গি প্রতিরোধে এমন বেহাল দশা কেন? শীত দোরগোড়ায়। তবু কেন ডেঙ্গি পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে
এল না?

এ বছর থেকে শিক্ষা নিয়ে আগামী বছর পুরসভা যদি ডেঙ্গি নিয়ন্ত্রণে আগেভাগে কাজ শুরু না করে, তা হলে এলাকাবাসী নিশ্চিত, ‘আসছে বছর আবার হবে।’

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement
Advertisement