লুপ্তপ্রায়: হারিয়ে যাচ্ছে এই দৃশ্য। নিজস্ব চিত্র
কয়েক বছর আগেও থাকতেন পাড়ার গিন্নিরাই। আর চারপাশ ম-ম করে তুলত সেই সৌরভ।
এখন পুজো বহরে বাড়লেও সচরাচর তার দেখা নেই।
এ যুগে মাটির খুরি বা শালপাতায় বাড়িতে বাড়িতে খিচুড়ি-লাবড়া পরিবেশন অনেকেরই পোষাচ্ছে না। খিচুড়ির মাখামাখি ব্যাপারটার বদলে প্যাকেটের পোলাওয়েই সুবিধে। ভোগের পোলাও অবশ্য ঠিকঠাক পোলাও নয়। কারণ পোলাও তথা পলান্নে মাংস থাকতে হয়। পুজোর মেনুতে ঘি ছড়ানো মিষ্টি ভাতটাই সাধারণত চলে। একেলে রুচির অপভ্রংশে তা অনেক সময়েই ফ্রায়েড রাইস অবতার! গিন্নিদের বদলে আসরে নেমেছে কেটারিং সংস্থা। আজাদগড়ের জনৈক বাসিন্দা বলছিলেন, ‘‘আমাদের পাড়ার সেবক সঙ্ঘের পুজোয় সদস্যদের যা খাওয়ানো হয়, তাতে মিষ্টি ভাত বা ফ্রায়েড রাইসেরই রমরমা।’’
এই কর্পোরেট জমানায় পুজো বহরে বাড়লেও বাজেটের বারো আনাই থিমের দখলে। জনৈক রাজনৈতিক দাদার আশীর্বাদধন্য দক্ষিণ কলকাতার একটি পুজোর কর্তা বলছিলেন, ‘‘এই বিপুল ভিড়কে কী করে বসিয়ে খাওয়াই! বিকেলে নমো-নমো করে প্রসাদ দেওয়া হয়।’’ চেতলা অগ্রণী-র পুজোয় এমনিতে অষ্টমীর ভোগ খেতে বড়সড় লাইন পড়ে। তবে নবমীর আমিষ মেনুটা ক্লাবের সদস্যদের জন্য। ত্রিধারা সম্মিলনীতেও ক্লাব-সদস্য, স্বেচ্ছাসেবককুল— সবার জন্য রাজসূয় যজ্ঞ। নবমীতে চিংড়ি-পার্শে-মাটন যোগে রীতিমতো ফাঁসির খাওয়া! তবে কলকাতার বারোয়ারি পুজো ইদানীং ঠিক পাড়া-কেন্দ্রিক নয়, আদতে ক্লাব-কেন্দ্রিক।
কিছু সাবেক পুজোর অবশ্য অন্য ধারা। ম্যাডক্স স্কোয়ারের পুজোয় সপ্তমী-অষ্টমী-নবমী হাজার দুয়েক লোক খিচুড়ি, পোলাও, পাঁচ রকম ভাজা ও পায়েস প্রসাদ পাবেন। শালপাতা থেকে থার্মোকলের থালার জমানাতেও এই পরম্পরা। একডালিয়ার পুজোয় তিন দিনই একসঙ্গে খাবে গোটা পাড়া। অষ্টমীতে গড়িয়াহাটের দোকানদারেরাও অতিথি।
পুরনো পড়শি, সত্তরোর্ধ্ব তপতী বন্দ্যোপাধ্যায়কে এ সময়ে মাথায় করে রাখেন পুজোর ছেলেপুলেরা। পুজোর ভোগের তুলাইপাঞ্জি চালের প্রতি সুবিচার করা সবার কম্মো নয়। উনিই জানেন, বাচ্চা ছেলেকে চান করানোর মমতায় কী ভাবে চালের জল ঝরাতে হবে। বাগবাজারের পুজোতেও পাড়ার মা-মাসিদের নেতৃত্বে প্রমীলা-বাহিনী ভোগের দায়িত্ব সামলান। কাশী বোস লেনের পুজোর বড় আকর্ষণ, নবমীর ছাপ্পান্ন ভোগ। বাঙালি ঘরানার সঙ্গে উত্তর ভারতের রীতির মিশেলে তদারকি করেন হিন্দিভাষী-বাঙালি গিন্নিরা। পাড়া-সর্বস্ব একটা চরিত্র থেকে থিম-দৌড়ে সদ্য ঢুকে পড়েছে টালা প্রত্যয়ের পুজো। সেখানে ভোগটা পাড়ার মেয়েরাই সামলান।
দশভুজা এই প্রমীলা-ব্রিগেড কালের নিয়মেই বিদায় নিচ্ছেন। সেই সঙ্গে সাবেক খিচুড়িও অস্তগামী।
পাড়ার লোকেদের হাতের ছোঁয়ার এই আন্তরিকতাটুকুর জায়গায় খাবার প্যাকিংয়ে ওস্তাদ কেটারারদেরই রমরমা। কিছু ব্যতিক্রমও অবশ্য ঘটছে। এই বাজারে হিন্দুস্তান পার্ক সর্বজনীনের অষ্টমীর মেনুতে কিন্তু খিচুড়ি ফিরছে। বছর দশেক ধরে পোলাও, পনির, নবরত্ন কোর্মা গোছের মেনুই চলছিল। তার বদলে আসরে নেমেছেন দক্ষ রান্নার ঠাকুর। খিচুড়ি-লাবড়া-বেগুনির প্রত্যাবর্তন।
গোটা কলকাতার নিরীখে এটা অবশ্যই উলটপুরাণ।