আর্মহার্স্ট স্ট্রিট।
এক রাতেই বদলে গেল ছবিটা!
তা সে খাস কলকাতাই হোক কিংবা সহোদর হাওড়া। প্রতিবেশী সল্টলেক ও উত্তর-দক্ষিণের শহরতলিও রেহাই পায়নি বৃষ্টির জমা জলের হাত থেকে।
হাওয়া অফিসের খবর, শুক্রবার সকাল থেকে শনিবার পর্যন্ত কলকাতায় ১৩৪ মিলিমিটার বৃষ্টি হয়েছে। তার ফলেই এমন জলবন্দি অবস্থা। কলকাতার রাস্তা দেখে অনেকেই নদীর সঙ্গে মিল খুঁজে পেয়েছেন। হাওড়ার জলমগ্ন হাসপাতালে সাপের আতঙ্কে অনেক রোগীই বাড়ি ফিরে গিয়েছেন। দমদম মেট্রোর কাছে একটি সরকারি আবাসনের একতলার বাসিন্দাদের ঘর ছেড়ে উপরের তলায় আশ্রয় নিতে হয়েছে। জলমগ্ন রাস্তায় যানবাহনও সে ভাবে মেলেনি। মওকা বুঝে বেশি ভাড়া হেঁকেছেন অটো ও ট্যাক্সিচালকেরা।
কেমন ছিল এ দিনের দুর্ভোগ-চিত্র?
কলকাতা: উত্তর থেকে দক্ষিণ, রাতভর বৃষ্টিতে সর্বত্রই জল থইথই। বন্দর এলাকার গার্ডেনরিচ থানার ভিতরেই হাঁটুডোবা জল। জল-ঝঞ্ঝাট সামলানোর মাঝখানে আসামি পালিয়ে না-যায়, তা নিশ্চিত করতে শনিবার সকাল ৯টাতেই তাঁদের আদালতে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন থানার কর্তারা। লালবাজার বলছে, শহরের অন্তত ৮০টি রাস্তা এ দিন জলে ডুবেছিল। তার মধ্যে মারাত্মক অবস্থা ছিল আমহার্স্ট স্ট্রিট, চিত্তরঞ্জন অ্যাভিনিউ, পার্ক স্ট্রিট, এজেসি বসু রোড, শরৎ বসু রোড, পার্ক সার্কাসের। খিদিরপুরের ফ্যান্সি মার্কেটের সামনে কোমর পর্যন্ত ডুবে যাচ্ছিল। বাঁশদ্রোণী, মুকুন্দপুর, সন্তোষপুরেও জল থইথই অবস্থা। বহু বাড়ির একতলাতেও জল ঢুকেছিল। গল্ফ গার্ডেন, বেলগাছিয়ার মতো পাড়াতেও এ দিন জলবন্দি হয়ে পড়েছিলেন বাসিন্দারা। টালা পার্ক লাগোয়া এলাকায় বাড়ি থেকে পা ফেললেই জল। সুযোগ বুঝে রিকশাচালকেরা মোটা দর হেঁকেছেন। একই অবস্থা হয়েছে ট্যাক্সি ধরতে যাওয়া লোকজনেরও।
রাস্তার দুর্ভোগ এড়াতে অনেকেই মেট্রো ধরে যাচ্ছিলেন। কিন্তু সকাল ৮টা নাগাদ রবীন্দ্র সরোবর স্টেশনে দমদমগামী একটি মেট্রো আটকে যায়। তার জন্য ২০ মিনিট মেট্রো চলাচল ব্যাহত হয়। জোকা, বেহালা, ঠাকুরপুকুর এলাকায় অটোর দেখা মেলেনি। জল এড়াতে অনেক অটোই ঘুরপথে গিয়েছে। অনেক রুটেই অটোচালকেরা ভাড়া বেশি চেয়েছেন বলে অভিযোগ উঠেছে।
রাস্তায় ট্যাক্সি কম থাকায় শিয়ালদহ ও হাওড়া স্টেশনের প্রি-পেড বুথে লম্বা লাইন পড়ে ট্রেনযাত্রীদের। এ ছাড়া ট্রেন চলাচল বিঘ্নিত হওয়ায় ওই দুই স্টেশনের প্ল্যাটফর্মে ছিল যাত্রীদের উপচে পড়া ভিড়। বেসরকারি বাস সংগঠনগুলির পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, শুক্রবারের রাতভর বৃষ্টির ফলে এ দিন রাস্তায় প্রায় ২০ শতাংশের বেশি বাস নামেনি। সরকারি সূত্রে জানানো হয়েছে, অন্য দিনের মতো একই পরিমাণ সরকারি বাস এ দিন রাস্তায় নেমেছিল। তবে সকালের দিকে রাস্তায় জল থাকায় বিভিন্ন রুটের বাস ঘুরপথে চালাতে হয়েছে।
হাওড়া: কারখানায় কাজ করতে গিয়ে মেশিনে ডান হাত জখম হয়েছিল চাঁদু মিশ্রের। টি এল জায়সবাল হাসপাতালে যাওয়ার জন্য বেলা ১০টায় জিটি রোডে দীর্ঘক্ষণ অপেক্ষা করার পরও বাস বা কোনও যানবাহন পাননি বেলুড়ের বাসিন্দা চাঁদুবাবু এবং তাঁর এক আত্মীয়। অগত্যা ১৫০ টাকা ভাড়ায় রিকশায় চেপে তাঁরা জিটি রোড ধরে হাসপাতালের দিকে রওনা হলেন। কিন্তু দ্রুত যাবেন কী করে? গোটা জিটি রোড থইথই করছে হাঁটুজলে। কোনওক্রমে তাঁরা যখন হাসপাতালে পৌঁছলেন তখন জলে দাঁড়িয়েই নার্সদের তাঁর হাতের ব্যান্ডেজ বাঁধতে হল। কারণ, গত ২৪ ঘণ্টা টানা বর্ষণে শুক্রবার রাত থেকেই জলমগ্ন গোটা হাসপাতাল। সেই জল শনিবার রাত পর্যন্ত নামেনি।
একই চিত্র জিটি রোডের পাশেই রাজ্যের দ্বিতীয় বৃহত্তম আইডি হাসপাতাল সত্যবালা আইডি হাসপাতালের। হাসপাতালটিতে সংস্কারের কাজ শুরু হলেও জমা জলের সমস্যা যে আজও যে মেটেনি এবং হাওড়ার ‘লাইফ লাইন’ জিটি রোডের হালও যে ফেরেনি এ দিনের দু’টি চিত্রতেই পরিষ্কার। প্রতি বছরের মতো এ বারেও দেখা গেল, হাসপাতালের ভিতরে হাঁটুজল। এর সঙ্গে যোগ হয়েছে সাপের উপদ্রব। আতঙ্কিত রোগীরা সকলেই প্রায় পালিয়ে গিয়েছেন। একমাত্র ভর্তি রয়েছে ১৪ বছরের এক বালক। হাসপাতাল সূত্রে জানা গিয়েছে, বাড়ির কেউ তাকে নিতে না আসায় সে যেতে পারেনি।
দু’টি সরকারি হাসপাতালের এই চিত্র থেকে পরিষ্কার, টানা বৃষ্টিতে কেমন হাল হয়েছে হাওড়া শহরের। পুরসভা সূত্রে খবর, বৃষ্টির জেরে পুরসভার ৫০টি ওয়ার্ডের মধ্যে ২০টি ওয়ার্ড জলে ভেসেছে। সব থেকে খারাপ অবস্থা উত্তর হাওড়ার ৭ নম্বর ওয়ার্ডের। সেখানকার বামনগাছি, বি রোড, সি রোড, কলাবাগান-সহ অপেক্ষাকৃত নিচু এলাকাগুলির বাড়ির ভিতর জল ঢুকে যাওয়ায় রান্নাবান্না বন্ধ হয়ে গিয়েছে গৃহস্থের। একই অবস্থা হয়েছে উত্তর হাওড়ার ২, ৩, ৪, ৫, ৬, ৯, ১০ ও ১৫ নম্বর ওয়ার্ডের। কোথাও হাঁটু জল, কোথাও কোমর-সমান জল জমে গিয়েছে এলাকাগুলিতে। এ ছাড়া ৮, ২১, ২২, ৪৫, ৪৬, ৪৭, ৪৮, ৪৯ ও ৫০ ওয়ার্ডের সব থেকে নিচু এলাকাগুলিতেও দিনভর জমা জলে নাকাল হতে হয়েছে বাসিন্দাদের। পুরসভার নিকাশি দফতরের ভারপ্রাপ্ত মেয়র শ্যামল মিত্র বলেন, ‘‘জরুরি ভিত্তিতে এ দিন প্লাবিত এলাকাগুলিতে যাঁরা আটকে গিয়েছেন তাঁদের উদ্ধার করে স্কুল বা ক্লাবে রাখা হয়েছে। তাঁদের ত্রিপল, খিচুড়ি, ওআরএস, জল, চিঁড়ে-গুড় ত্রাণে দেওয়া হয়েছে।
মেয়র রথীন চক্রবর্তী বলেন, ‘‘যে পরিমাণে বৃষ্টি হয়েছে তাতে জল জমবেই। এর উপর ভরা কোটাল চলায় জলস্তর অনেক উঁচুতে। তাই শহরের জমা জল বেরোতে পারছে না। তবে বিকালে ভাটার পর জল ধীরে ধীরে নেমে যাচ্ছে বলে শুনেছি।’’ পুরসভা সূত্রে জানা গিয়েছে, এ দিন সকাল থেকে কলকাতার মতো হাওড়া পুরসভার কাউন্সিলররাও রাস্তায় নেমে ত্রাণ ও উদ্ধারকার্য পরিচালনা করেন।
সল্টলেক: টানা বৃষ্টিতে জল জমেছে সল্টলেকের বিভিন্ন জায়গাতেও। জে কে সাহা ব্রিজ থেকে পাঁচ নম্বর সেক্টর পর্যন্ত পৌঁছতে যাত্রীদের রিকশাভাড়া ছিল ১০০ টাকা। নিউটাউনের এসডিএফ মোড়, কলেজ মোড়ও জলমগ্ন হয়ে পড়েছে। তথ্যপ্রযুক্তি তালুকের কর্মীদের অফিস পৌঁছতে নাকাল হতে হয়েছে। বিধাননগর পুরসভা কর্তৃপক্ষ জানান, ভারী বৃষ্টিতে করুণাময়ী, তিন, চার কিংবা পাঁচ নম্বর সেক্টরে জল জমলেও বৃষ্টি থামার পরে ধীরে ধীরে ইস্টার্ন ড্রেনেজ খাল দিয়ে সেই জমা জল বেরোতে থাকে। তবে সল্টলেকেও এ দিন বাস অনেক কম ছিল। তার ফলে বাদুড়ঝোলা ভিড় নজরে পড়েছে। দুর্ভোগ পোহাতে হয়েছে অনেক নিত্যযাত্রীকে। বৃষ্টিতে ইসি ব্লকে একটি বড় গাছ উপড়ে পড়েছে।
শহরতলি: বাগুইআটি, দমদম-সহ শহরতলির বিভিন্ন জায়গায় জল জমেছে। চিনার পার্ক, সাহাপাড়া, বাগুইআটি-সহ বহু এলাকায় হাঁটুডোবা জল দাঁড়িয়েছিল। সুযোগ বুঝে স্বাভাবিকের থেকে আট-দশ গুণ ভাড়া নিয়েছেন রিকশাচালকেরা। দমদম মেট্রো স্টেশনের কাছে একটি সরকারি আবাসনে জল জমে নাকাল হয়েছেন বাসিন্দারা। একতলার অনেক ঘরেই জল ঢুকে গিয়েছিল। জিনিসপত্র বাঁচাতে ইটের উপরে খাট, টিভি তুলতে হয়েছে। বাসিন্দাদের একাংশের অভিযোগ, সামান্য বৃষ্টিতেই আবাসনে জল জমে। উপরতলার ফ্ল্যাট ফাঁকা থাকলেও নিয়মের গেরোয় তাঁরা সেগুলো পাচ্ছেন না। ফলে বর্ষাকালে দুর্ভোগ লেগেই থাকে। বারাসত ও মধ্যমগ্রাম পুরসভার অনেক জায়গায় জল জমে রয়েছে। টানা বৃষ্টিতে ভাঙাচোরা যশোহর রোডে গর্তগুলি জলে ভরাট হয়ে গিয়েছে। তার ফলে গাড়ি চলাচল বিপর্যস্ত। শুক্রবার রাতেই এই যন্ত্রণা পোহাতে হয়েছে যাত্রীদের। সোমবার অশোকনগর ও হাবরায় যাবেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তাই রাস্তার হাল নিয়ে পুরসভা ও পূর্ত দফতরের সঙ্গে বৈঠক করেন খাদ্যমন্ত্রী জ্যোতিপ্রিয় মল্লিক।