বেলাগাম স্কুটি, প্রশ্নে পুলিশি নজর

মঙ্গলবার রাত ১১টা নাগাদ মিন্টো পার্কের কাছে এ জে সি বসু রোডে স্কুটি দুর্ঘটনায় মৃত্যু হয়েছে ওবাইদ হোসেন (১৮) ও সাহিল খানের (২১)। আহত হয়েছেন মহম্মদ রাজু নামে আর এক আরোহী।

Advertisement

নিজস্ব সংবাদদাতা

শেষ আপডেট: ২৮ জুন ২০১৮ ০২:৪৫
Share:

বেপরোয়া: কানে গোঁজা হেডফোন, মাথায় নেই হেলমেট। মহম্মদ আলি পার্কের কাছে চিত্তরঞ্জন অ্যাভিনিউয়ে স্কুটির দুই আরোহী।

দু’রাতে মৃতের সংখ্যা চার! কলকাতার রাজপথে এটাই স্কুটি দুর্ঘটনার সাম্প্রতিক পরিসংখ্যান। পুলিশ জানিয়েছে, মৃতদের কারও মাথাতেই হেলমেট ছিল না। প্রশ্ন উঠেছে, স্কুটি কি তা হলে ট্র্যাফিক আইনের ঊর্ধ্বে? কী ভাবে নিয়ম ভেঙে পথেঘাটে স্কুটি নিয়ে বেরোচ্ছেন অল্পবয়সীরা?

Advertisement

মঙ্গলবার রাত ১১টা নাগাদ মিন্টো পার্কের কাছে এ জে সি বসু রোডে স্কুটি দুর্ঘটনায় মৃত্যু হয়েছে ওবাইদ হোসেন (১৮) ও সাহিল খানের (২১)। আহত হয়েছেন মহম্মদ রাজু নামে আর এক আরোহী। তিন জনেরই বা়ড়ি নারকেলডাঙা নর্থ রোডে। পুলিশ জানিয়েছে, ওবাইদের লাইসেন্স ছিল না। তিন জনের কারও মাথায় হেলমেটও ছিল না। সোমবার উল্টোডাঙার মুচিবাজারে দু’টি বাসের রেষারেষির মধ্যে পড়ে মারা যায় একটি স্কুটির আরোহী দুই কিশোর। আহত হন স্কুটিচালক যুবকও। প্রসঙ্গত, রবিবার লেক গার্ডেন্সে মোটরবাইক দুর্ঘটনায় মৃত্যু হয় সৌরদীপ সিংহ নামে এক যুবকের। তিনিও হেলমেট পরে ছিলেন না বলে পুলিশ সূত্রের দাবি।

প্রাথমিক তদন্তে জানা গিয়েছে, মঙ্গলবার রাতে ওই তিন জনের সঙ্গে আরও তিন বন্ধু ছিলেন। তাঁরা অন্য একটি মোটরবাইকে আসছিলেন। ফেরার পথে মোটরবাইক ও স্কুটির প্রতিযোগিতা চলছিল। ভেজা রাস্তায় নিয়ন্ত্রণ হারান ওবাইদ। প্রথমে ডিভাইডারের রেলিংয়ে ধাক্কা মারেন। নিজেদের স্কুটির নীচেই চাপা পড়েন সাহিল ও ওবাইদ। দূরে ছিটকে পড়ায় বেঁচে যান রাজু। মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণের ফলেই দু’জনের মৃত্যু হয়েছে বলে সূত্রের দাবি। মোটরবাইকটির আরোহী ইসমাইল আনোয়ার বলেন, ‘‘রাজুর চিৎকার শুনে আমরা ফিরে আসি। ওবাইদ ও সাহিল লুটিয়ে পড়েছিল। আমরা মোটরবাইক ও স্কুটিতে চাপিয়ে ওদের এনআরএস হাসপাতালে নিয়ে যাই।’’ অভিযোগ, হাসপাতাল থেকেই ‘উধাও’ হয়ে গিয়েছেন রাজু।

Advertisement

ওবাইদের মা শাহজাদি বেগম বলেন, ‘‘রাত ১০টা নাগাদ বলে গেল, খিদিরপুরে যাচ্ছে। রাত বারোটায় শুনি এই ঘটনা। সাহিলের বাবা ফিরোজ খান পেশায় ভ্যানচালক। তিনি বলেন, ‘‘বাইরে কোনও চোট নেই। দু’জনের মৃত্যু হল, কিন্তু রাজু বেঁচে গেল! রাজুকে জিজ্ঞাসা করে সত্য উদ্ঘাটন করুক পুলিশ।’’

বড়রা হেলমেট পরে থাকলেও শিশুদের মাথা অরক্ষিতই। ধর্মতলায়।

পুলিশ সূত্রের দাবি, স্কুটির চাহিদা তরুণ-তরুণীদের মধ্যে বাড়ছে। কিন্তু অধিকাংশ ক্ষেত্রেই চালক ও আরোহীরা হেলমেট পরেন না। একই প্রবণতা দেখা যায় অল্পবয়সী মোটরবাইক আরোহীদের মধ্যেও। হেলমেটে তাঁদের অনেকেরই অনীহা।

স্কুটি চালানোর লাইসেন্সের নিয়মও মোটরবাইকের লাইসেন্সের তুলনায় শিথিল। ফলে অনেক ক্ষেত্রেই রাস্তায় গাড়ি চালানোর নিয়ম না শিখেই স্কুটি নিয়ে বেরিয়ে পড়ছেন চালকেরা। শুধু এখানেই শেষ নয়, স্কুটি নিয়ে রেসও হচ্ছে আকছার। তার ফলেই দুর্ঘটনায় প্রাণ হারাচ্ছেন অল্পবয়সীরা। হেলমেট পরে এবং নিয়ন্ত্রিত গতিতে স্কুটি, মোটরবাইক চালানো নিয়ে পুলিশ কিংবা আমজনতার অনেকে প্রচার চালালেও তার ফল যে পুরোপুরি মিলছে না, তা-ও হাতেনাতে প্রমাণ হচ্ছে। পথেঘাটে স্কুটির হেলমেটহীন সওয়ারি হামেশাই চোখে পড়ে। তা হলে কি স্কুটির লাইসেন্সের নিয়মে বদল আনার প্রয়োজন রয়েছে? কলকাতা পুলিশের যুগ্ম কমিশনার (ট্র্যাফিক) মিতেশ জৈন বলেন, ‘‘বিষয়টি খতিয়ে দেখছি।’’

স্কুটি বিধি

• মোটরবাইক ও গিয়ারহীন স্কুটারের (আধুনিক স্কুটি) আলাদা লাইসেন্স।

• স্কুটির লাইসেন্স পেতে ন্যূনতম বয়স ১৭ বছর। সে ক্ষেত্রে অভিভাবকের সম্মতিপত্র বাধ্যতামূলক।

• লাইসেন্স পেতে হলে নির্দিষ্ট পরীক্ষায় পাশ করতে হয়।

• স্কুটি চালানোর সময়ে হেলমেট পরা বাধ্যতামূলক। চালককে পা ঢাকা জুতো পরতে হবে।

• কম গতির ব্যাটারিচালিত স্কুটার (সর্বোচ্চ গতি ২৫ কিলোমিটার/ঘণ্টা) মোটর ভেহিক্‌ল আইনের আওতায় পড়ে না। তাই লাইসেন্স বাধ্যতামূলক নয়।

• স্কুটি নিয়ে বেরোলে লাইসেন্স, বিমার নথি, রোড ট্যাক্স, দূষণ সংক্রান্ত ছাড়পত্র সঙ্গে রাখতে হবে।

*১৯৮৯ সালের মোটর ভেহিক্‌ল
আইন অনুসারে

এ-ও প্রশ্ন উঠেছে, পথেঘাটে নিয়ম ভেঙে স্কুটি চালালেও কেন ধরা পড়ছে না কেউ? তা হলে কি পুলিশি ধরপাকড়ে খামতি রয়েছে? কেনই বা রাতের শহরে লাগাতার দুর্ঘটনা ঘটছে? রাত ১০টা পেরোলেই কি নজরদারি শিথিল হচ্ছে? নজরদারির অভাব নেই বলে দাবি করে যুগ্ম কমিশনার বলেন, ‘‘যথেষ্ট ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। রাস্তায় পুলিশ তো থাকেই। তা ছাড়া, বিশেষ অভিযানও চলে।’’

বস্তুত, রাজ্যে ‘সেফ ড্রাইভ, সেভ লাইফ’ প্রকল্প নিয়ে হাজারো প্রচার চলে। তারই অঙ্গ হিসেবে ‘নো হেলমেট, নো পেট্রোল’ অভিযানও শুরু হয়েছিল। অর্থাৎ, হেলমেট না থাকলে পেট্রোল পাম্প থেকে জ্বালানি দেওয়া হত না। যদিও অনেকেরই অভিজ্ঞতা, সে সবের পাট চুকে গিয়েছে বললেই চলে। তা হলে ‘সেফ ড্রাইভ, সেভ লাইফ’ প্রকল্পের সার্থকতা কোথায়? এই প্রকল্প অনেকটাই সার্থক দাবি করে যুগ্ম কমিশনারের বক্তব্য, ‘‘গত বছরের পরিসংখ্যানের সঙ্গে মিলিয়ে দেখুন। দুর্ঘটনা কমেছে।’’

ছবি: সুদীপ্ত ভৌমিক ও সুমন বল্লভ

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন