গোরস্থানে ‘গোলমাল’ ঠেকাতে বিলিতি ত্রাতা 

বড়দিন এবং বর্ষবরণের উৎসবের জন্য প্রতি বছর কলকাতার অন্যতম সাহেবপাড়া পার্ক স্ট্রিট চত্বর সেজে ওঠে রাজ্য সরকারের উদ্যোগে। ব্যতিক্রম হবে না এ বারেও। কিন্তু পার্ক স্ট্রিটের অদূরে মল্লিকবাজারে সেই সাহেবদেরই গোরস্থানের দিকে যেন নজর পড়ে না কোনও মহলের।

Advertisement

ঋজু বসু

শেষ আপডেট: ১৯ ডিসেম্বর ২০১৮ ০০:২৪
Share:

মল্লিকবাজার সমাধিক্ষেত্রে মাথাবিহীন মূর্তি। ছবি: দেশকল্যাণ চৌধুরী

প্রদীপের নীচে অন্ধকার।

Advertisement

বড়দিন এবং বর্ষবরণের উৎসবের জন্য প্রতি বছর কলকাতার অন্যতম সাহেবপাড়া পার্ক স্ট্রিট চত্বর সেজে ওঠে রাজ্য সরকারের উদ্যোগে। ব্যতিক্রম হবে না এ বারেও। কিন্তু পার্ক স্ট্রিটের অদূরে মল্লিকবাজারে সেই সাহেবদেরই গোরস্থানের দিকে যেন নজর পড়ে না কোনও মহলের। চোরেদের উপদ্রবে খোয়া যাচ্ছে কলকাতার প্রাচীন নিউ বেরিয়াল গ্রাউন্ড তথা মল্লিকবাজার সমাধিক্ষেত্রের বহু স্থাপত্যের নিদর্শন। সমাধিসৌধে চলছে ভাঙচুরও। কর্তৃপক্ষের অভিযোগ, পুলিশ ও প্রশাসনের দ্বারস্থ হয়েও লাভ হয়নি। ফলত, বড়দিনের প্রাক্কালে মল্লিকবাজারের ওই কবরস্থানের ভোল বদলের জন্য এ বার কর্তৃপক্ষ দ্বারস্থ হচ্ছেন ব্রিটিশ অ্যাসোসিয়েশন ফর সেমেট্রি প্রিজার্ভেশন ইন সাউথ এশিয়া (বাকসা)-র। তাদের উদ্যোগে সংস্কারের ছোঁয়া লাগবে মল্লিকবাজারে ছ’টি গুরুত্বপূর্ণ সমাধিসৌধে। ১২-১৩ হাজার কবর রয়েছে সেখানে। এ বার তা গণনার কাজ হবে বলে জানাচ্ছেন ক্রিশ্চান বেরিয়াল বোর্ডের কর্তারা।

বোর্ডের সদস্য রণজয় বসু-র আক্ষেপ, ‘‘এশিয়ার অন্যতম বৃহৎ এই সমাধিক্ষেত্র গ্রেড-১ হেরিটেজ ঘোষণা হয়েছে বহু দিন আগেই। কিন্তু সমাধিসৌধে ভাঙচুর, চুরি ঠেকানো যাচ্ছে না।’’ তিনি বলেন, ‘‘আগে সরকারি দফতর কিছু কাজ করেছে। সমাধিক্ষেত্রের পরিস্থিতিও সবার জানা। আমাদের উপদেষ্টা সংস্থা হিসেবেই বাকসা এগিয়ে এসেছে।’’

Advertisement

বোর্ডের অভিযোগ, প্রয়াত লেসলি ক্লডিয়াসের হকিস্টিকধারী মূর্তির সঙ্গে থাকা বল উধাও হয়ে গেছে। মাস কয়েক আগে পার্ক স্ট্রিটের গোরস্থানে মন্দিরের আদলে ‘হিন্দু স্টুয়ার্ট’-এর সমাধি থেকে চুরি হয়েছে খোদাই করা পদ্মফুল। ফটকে সিসি ক্যামেরা থেকেও নিস্তার নেই। তাই এ বার মল্লিকবাজার গোরস্থানের অন্দরের মলিন, ক্ষতবিক্ষত চেহারাটা বদলাতে উদ্যোগী হয়েছে বেরিয়াল বোর্ড।

মাইকেল মধুসূদন দত্ত, শিক্ষাবিদ বেথুনসাহেব, মোহনবাগানের ’১১ সালের শিল্ডজয়ী ফুটবলার রেভারেন্ড সুধীর চক্রবর্তীর মত বিশিষ্টদের সমাধি রয়েছে মল্লিকবাজারে। সেখানে এক সময় রাস্তা তৈরি করে দিয়েছিল রাজ্য। বাকসা-র পৃষ্ঠপোষকতায় মল্লিকবাজারে এ বার লালবাজারের আদি যুগের পুলিশ-ম্যাজিস্ট্রেট উইলিয়ামস কোটস ব্ল্যাকিয়েরের সমাধির সংস্কার হওয়ার কথা। ১৮৫৫ তে ৯৪ বছরে তিনি মারা যান। ব্ল্যাকিয়েরের সমাধিফলকে লেখা, হুগলি, নদিয়া, যশোরের ডাকাত-দমন কিংবা পুলিশের ‘সোর্স’ তথা চর নিয়োগে তাঁর ভূমিকার কথা। ওই গোরস্থানেই রয়েছে মহারানি ভিক্টোরিয়ার আমলে এ দেশে করব্যবস্থার আদি রূপকার জেমস উইলসনের সমাধি। উইলসনের মৃত্যুদিনে প্রতি বছর আয়কর দফতরের বড় কর্তারা তাঁকে শ্রদ্ধা জানাতে মল্লিকবাজারে আসেন।

আর্কিয়োলজিক্যাল সার্ভে অব ইন্ডিয়া-র প্রাক্তন কর্তা অসিত বন্দ্যোপাধ্যায় বলছিলেন, ‘‘গোরস্থান জুড়ে লম্বাটে গম্বুজ ওবেলিস্ক, প্রকাণ্ড ভস্মাধার আর্ন বা কফিনাকৃতি সার্কোফেগাস-এর ছড়াছড়ি। সবই প্রাচীন গোরস্থান স্থাপত্যের নিদর্শন।’’

বেরিয়াল বোর্ডের সচিব অসীম বিশ্বাসের কথায়, ‘‘উনিশ শতকে নিয়মিত জাহাজে আসত বিলেতের মার্বেল, স্যান্ডস্টোন বা স্কটিশ গ্র্যানাইট। নিজেদের সমাধিসৌধ নিয়ে গণ্যমান্যদের যত্নের শেষ ছিল না।’’ কয়েক মাস আগে এমনই একটি ভাঙাচোরা ধুলোমলিন ক্রুশচিহ্ন খচিত প্রস্তরখণ্ড থেকে খোঁজ মেলে ১৮৯২-এ প্রয়াত ডায়োসেশন স্কুলের প্রতিষ্ঠাতা এঞ্জেলিনা মার্গারেট হোরের সমাধির। স্কুল কর্তৃপক্ষের সাহায্যে সৌধটির হাল ফিরেছে। কিন্তু বোর্ড কর্তারা মানেন, বহু ইতিহাস হারিয়ে যাচ্ছে। বিক্ষিপ্ত সংস্কার চললেও এখনও সৌধের গায়ে ডানা বা মাথাহীন ‘এঞ্জেল’দের দেখা মিলবে।

হেরিটেজ কমিশনের তরফে চন্দননগরের গির্জা লাগোয়া ‘সিমেট্রি’ সংরক্ষণে কিছু কাজ হলেও কলকাতার সমাধিক্ষেত্র নিয়ে পুরসভার কোর্টে বল ঠেলছে তারা। পুরসভার হেরিটেজ কমিটির আহ্বায়ক সুব্রত শীলের কথায়, ‘‘নির্দিষ্ট প্রস্তাব এলে দেখব।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন