নন্দ মল্লিক লেন

আজও ভোগায় জমা জল, ইঁদুরের উপদ্রব

কখনও প্রশস্ত কখনও সঙ্কীর্ণ রাস্তাটা এক রাজপথ থেকে শুরু হয়ে এঁকেবেঁকে আর এক রাজপথে মিশেছে। বৈশাখের ঘাম ঝরা বিকেলে আপন ছন্দে এগিয়ে আসা টানা রিকশাটা দাঁড়িয়ে থাকা বাইকটার পাশ কাটিয়ে এগোতেই আচমকাই আটকে পড়া। ক্ষণিকের গঞ্জনা আর মুহূর্তের যানজট। তারই মাঝে পাশ কাটিয়ে ব্যস্ত পথচারী আর ঝুড়ি মাথায় ফেরিওয়ালার সন্তর্পণে এগিয়ে চলা।

Advertisement

শেখরকুমার মুখোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ২৩ এপ্রিল ২০১৬ ০১:১৯
Share:

কখনও প্রশস্ত কখনও সঙ্কীর্ণ রাস্তাটা এক রাজপথ থেকে শুরু হয়ে এঁকেবেঁকে আর এক রাজপথে মিশেছে। বৈশাখের ঘাম ঝরা বিকেলে আপন ছন্দে এগিয়ে আসা টানা রিকশাটা দাঁড়িয়ে থাকা বাইকটার পাশ কাটিয়ে এগোতেই আচমকাই আটকে পড়া। ক্ষণিকের গঞ্জনা আর মুহূর্তের যানজট। তারই মাঝে পাশ কাটিয়ে ব্যস্ত পথচারী আর ঝুড়ি মাথায় ফেরিওয়ালার সন্তর্পণে এগিয়ে চলা। এমনই সব পরিচিত ছবি নিয়ে আমার পাড়া নন্দ মল্লিক লেন।

Advertisement

নন্দ মল্লিক লেন সেন্ট্রাল অ্যাভিনিউ থেকে শুরু করে প্যারী দাস লেন পেরিয়ে রবীন্দ্র সরণিতে মিশেছে। ও পাশে বলরাম দে স্ট্রিট আর বিবেকানন্দ রোড। প্যারী দাস লেন গিয়ে মিশেছে রমেশ দত্ত স্ট্রিটে। কাছেই শেঠ বাগানের গলি, নিষিদ্ধ পল্লি আর পাড়ার পিছনে ডোম পাড়া। বরাবরই বৈচিত্রপূর্ণ আমাদের পাড়াটা। রয়েছে নানা সম্প্রদায়ের বসবাস।

সেই কাকভোরে পাড়ার সকালটা শুরু হয় দিলীপের চায়ের দোকানের উনুনের ধোঁয়ায়। সেখানেই সকাল সকাল চায়ের ভাঁড়ে চুমুক দিয়ে আড্ডা আর সৌজন্য বিনিময়টুকু সেরে ব্যস্ত কিছু মানুষ থলে হাতে ছোটেন বাজারে। একটু বেলা বাড়তেই বলাইবাবুর দোকানে কচুরি,তরকারি আর জিলিপি কিনতে আসা ক্রেতাদের ভিড়। ছেলেবেলায় ভোর হলেই চায়ের কেটলি আর স্নো’র কৌটোয় আদার কুচি নিয়ে বাড়ি বাড়ি চা দিতে হাজির হত মুন্নিলাল।

Advertisement

এ অঞ্চলে বরাবরই মিশ্র সংস্কৃতি। বাঙালিদের পাশাপাশি অবাঙালিদের বসবাস। রয়েছে তাঁদের সঙ্গে সুসম্পর্ক। এখন মানুষে মানুষে যোগাযোগ কমলেও আশপাশের বাড়ির বাসিন্দাদের সঙ্গে সুসম্পর্ক আজও রয়েছে। বিপদে আপদে এখনও তাঁরা পাশে দাঁড়ান। সাহায্যের চেষ্টা করেন। তাঁদের মধ্যে অবাঙালিরাও রয়েছেন।

কমেছে খেলাধুলোর পরিবেশ। আগে স্কুলফেরত ছোটরা মাঠে ছুটত। আমরাও রবীন্দ্র কাননে খেলতাম ক্রিকেট, ফুটবল, ব্যাডমিন্টন। এখন ছবিটা ভিন্ন। ছোটদের খেলার সময় কমেছে। তবে পাড়ার একটি ক্লাবের উদ্যোগে হয় এক দিনের ক্রিকেট টুর্নামেন্ট, ফুটবল প্রতিযোগিতা। এ পাড়ায় সন্ধ্যা হলেই বাহারি তেলেভাজার দোকানে ভিড় করেন ভোজন রসিকরা। আর বলাইবাবুর দোকানের জিভেগজা ও বোদের আকর্ষণও কম নয়।

পাড়াতেই রয়েছে গোপাল জিউর বহু পুরনো মন্দিরটি যা গোপালবাড়ি নামেই পরিচিত। দোল, ঝুলন, জন্মাষ্টমীর পাশাপাশি কালীপুজোর পরের দিন হয় অন্নকূট উৎসব। এক সময় ওখানেই ছিল গোপাল জিউ সঙ্ঘ নামক একটি ক্লাব। তার সঙ্গে যুক্ত ছিল পাড়ার যুব সম্প্রদায়। এখানেই ভারত সঙ্গীত বিদ্যালয় থাকায় ধ্রুপদী সঙ্গীত চর্চার চল ছিল। আগে সরস্বতী পুজোর সময় তিন দিন ব্যাপী জমজমাট সঙ্গীতানুষ্ঠান হত। আসতেন ভারতবিখ্যাত কত শিল্পী। সে সব আজ শুধুই স্মৃতি।

পরবর্তী কালে সত্তরের দশকে পাড়ার ক্লাব কল্যাণ পরিষদ গড়ে ওঠে। এখন তারই উদ্যোগে চালানো হয় একটি মর্নিং স্কুল, কোচিং সেন্টার। প্রতি বছর রক্তদান শিবির, বসে আঁকো প্রতিযোগিতা হয়। এ সব কিছুই হয় এলাকার মানুষের সাহায্যে। ভাবতে ভাল লাগে এখনও এতে কোনও রাজনৈতিক প্রভাব পড়েনি।

গর্ব করে বলতে পারি এখনও এ পাড়ায় তৈরি হয়নি একটিও ফ্ল্যাট। সবই বাড়ি। অন্য পাড়ার মতো এখানেও মিলছে উন্নত নাগরিক পরিষেবা। রয়েছে পর্যাপ্ত জলের জোগান, রাস্তায় বসেছে জোরালো আলো। নিয়মিত জঞ্জাল সাফাই হলেও কিছু মানুষের নাগরিক সচেতনতার অভাব থাকায় জঞ্জাল পরিষ্কার হওয়ার পর মুহূর্ত থেকেই ফের রাস্তা নোংরা হতে শুরু করে। তেমনই এ অঞ্চলে ভীযণ ইঁদুরের উপদ্রব। নালা, নর্দমা, ভ্যাটে তাদের বাসা। এখনও বৃষ্টি হলেই এখানে
জল জমে।

পাড়ার সেই জমাটি আড্ডার পরিবেশটা আর নেই। রকগুলি উধাও হওয়ার সঙ্গে উধাও হয়েছে আড্ডার পরিবেশ। এখন মাঝবয়সীরা ক্লাবে গিয়ে আড্ডা দেন। আর গলির মুখে চেয়ার পেতে যুবকদের আড্ডা দিতে দেখা যায়। পাড়ার পল্লিবাসী বৃন্দের দুর্গাপুজোটি বিশেষ আকর্ষণীয়। তেমনই শেঠ বাগান লেনের বহু পুরনো শিব মন্দিরটিতে চৈত্র সংক্রান্তির সময়ে হয় ঝাঁপ ও গাজন উৎসব। এ পাড়াতেই থাকতেন প্রখ্যাত অন্ধ সুরকার় রবীন্দ্র জৈন, ধ্রুপদ শিল্পী উদয়ভূষণ ভট্টাচার্য, ডোমপাড়ায় থাকতেন প্রখ্যাত অন্ধ পাখোয়াজ বাদক জীতেন সাঁতরা আর রাষ্ট্রপতি পুরষ্কার প্রাপ্ত ঢাক
বাদক বরেনবাবু।

কাছেই ডোম পাড়ায় এখনও তৈরি হয় ঝুড়ি, বেতের নানা সরঞ্জাম। অতীতে ওখানেই বিয়েবাড়ি ও শোভাযাত্রার জন্য কার্বাইড ল্যাম্পের আলোর সরঞ্জাম তৈরি করতেন বেশ কিছু শিল্পী। সেই সময় আজকের মতো আলোকসজ্জার প্রচলন ছিল না। আর থাকত বিয়েবাড়ির জন্য হুড খোলা গাড়ি যা বায়না অনুযায়ী নানা আকৃতিতে সাজানো হত।

সময়ের সঙ্গে কমেছে ফেরিওয়ালার ডাক। আজও মনে পড়ে সন্ধ্যাবেলা টিনের বাক্সে সেই ঘুগনি-আলুরদমওয়ালা, কুলফি-মালাইওয়ালা এবং বেলফুলওয়ালার কথা। তাঁরা কি সব হারিয়ে গেল?

চার পুরুষ এ পাড়ায় বসবাস করার পর কখনও এ পাড়াটা ছাড়ার কথা ভাবতে পারি না। এখানকার আকাশে বাতাসে মিশে আছে একটা টান। ওই যে বলে শিকড়ের টান, ব্যাপারটা অনেকটা সে রকম।

লেখক পরিচিত চিকিৎসক

ছবি: সুমন বল্লভ।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement
Advertisement