Samik Bandyopadhyay

বইয়ের বিপুল বৈভব এবং অতীতের সঙ্গে অনন্ত ভবিষ্যতের আত্মকথন

আগামী এখানে মুখোমুখি হতে পারবে অতীতের। অতীত সত্যি সত্যি ‘কথা বলবে’ অনন্ত ভবিষ্যতের সঙ্গে।

Advertisement

অনির্বাণ মুখোপাধ্যায়

কলকাতা শেষ আপডেট: ২১ জুন ২০২১ ১০:৩৩
Share:

শমীক বন্দ্যোপাধ্যায়। গ্রাফিক- শৌভিক দেবনাথ।

এমন কোনও গ্রন্থাগার কি সম্ভব, যেখানে বই তার আত্মকথা শোনাবে পাঠকের কানে কানে? বই তো শুধু বিষয়কে ধরে রাখে এমন নয়! বই নিজেও একটা বিষয় হয়ে দাঁড়ায়। মূল্যবান বা দুষ্প্রাপ্য বই মালিকানা বদলায়। এক সংগ্রাহক থেকে অন্য সংগ্রাহকের ভাঁড়ারে গিয়ে ওঠে। পাঠক কখনও বইয়ের মার্জিনে লিখে রাখেন তাঁর নিজস্ব টিকা-ভাষ্য। তখন সেই বই তার দুই মলাটের ভিতর ধরে রাখা বিষয়কে ছাপিয়ে অনেক দূরের দিগন্ত দেখতে পায়।

Advertisement

এমনটাই বলছিলেন শমীক বন্দ্যোপাধ্যায়। সদ্য ৮০ বছর পেরলেন এই সম্পাদক-প্রকাশক, অভিধান রচয়িতা এবং বিবিধ বিদ্যা চর্চাকারী মানুষটি। এই সব পরিচিতির মাঝখানে লুকিয়ে রয়েছে তাঁর আরেকটি পরিচয়। তিনি গ্রন্থ সংগ্রাহক। ৪০ হাজারেরও বেশি বই ও পত্রিকা রয়েছে তাঁর সংগ্রহে। ৮১ বছর বয়সে পা দিয়ে শমীক তাঁর বইয়ের এই বিপুল সংগ্রহ সর্বসাধারণের জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়ার কথা জানাচ্ছেন। সেই সঙ্গে জানালেন সম্ভাব্য গ্রন্থাগারটি এমন একটি সংগ্রহশালা হিসেবে গড়ে উঠবে, যার জুড়ি এই শহরে তো বটেই, এই দেশেও সম্ভবত নেই। এই বিপুল সংগ্রহের একাংশ শমীক উত্তরাধিকার সূত্রে পেয়েছেন। তাঁর বাবা সুনীত বন্দ্যোপাধ্যায় ছিলেন ইংরেজি সাহিত্যের নামকরা অধ্যাপক। এডিনবরা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তিরিশের দশকে গবেষণা করে পিএইচডি ডিগ্রি পান তিনি। এই ৪০ হাজার বইয়ের মধ্যে তাঁর সংগ্রহ থেকে রয়েছে কম করে ৫ হাজার বই। সেই সঙ্গে রয়েছে শমীকের মেজদা সমাজবিদ সুমন্ত বন্দ্যোপাধ্যায়ের সংগ্রহেরও বেশ কিছু বই।

ছবি সৌজন্য: বই বৈভব ফাউন্ডেশন। চিত্রগ্রাহক: কোয়েলা

কোথায় আলাদা আর পাঁচটা গ্রন্থাগারের চাইতে এই সংগ্রহ? শমীক জানাচ্ছেন, সব বই যে কেনা তা নয়। অনেক সময় উপহার সূত্রে পেয়েছেন। অনেক সময় লেখক স্বাক্ষর করে উপহার দিয়েছেন। সংগ্রহের একটা বড় অংশ পুরনো বইয়ের দোকান থেকে কেনা। অনেক সময়েই দেখা গিয়েছে, কোনও বিখ্যাত ব্যক্তির সংগ্রহ হাতফেরতা হয়ে চলে এসেছে কলেজ স্ট্রিট বা গোলপার্কের পুরনো বইয়ের দোকানে বা দুষ্প্রাপ্য বইবিক্রেতাদের হাতে। সে সব জায়গা থেকে বই কিনে দেখা গিয়েছে, বইয়ের মার্জিনে পেনসিল বা কলমে লেখা রয়েছে পূর্বতন মালিকের মন্তব্য বা ‘নোটস’। বইয়ের উৎসর্গের পাতায় কখনও থেকে গিয়েছে কিছু না কিছু আগ্রহব্যঞ্জক লেখা। এমন ভাবেই ধূর্জটিপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের সংগ্রহ চলে এসেছিল ফুটপাথে। প্রখ্যাত সমাজবিদ ও দর্শনভাবুকের সেই সংগ্রহ থেকে বেশ কিছু বই কিনে নেন শমীক। সেগুলির মধ্যে ছিল ফরাসি সাহিত্যিক আলব্যের কাম্যুর যুগান্তকারী প্রবন্ধগ্রন্থ ‘দ্য মিথ অব সিসিফাস’-এর ১৯৪২ সালে প্রকাশিত প্রথম সংস্করণ। এই বইয়ের মলাট উল্টোলেই দেখা যাবে ধূর্জটিপ্রসাদের নিজের হাতে লেখা মন্তব্য— ‘ব্রিলিয়ান্ট অ্যান্ড ওয়াইজ’। কিন্তু এই মন্তব্যের কিছুটা নীচেই মহারসিক ধূর্জটিপ্রসাদ লিখেছিলেন ‘মে বি মোর ব্রিলিয়ান্ট দ্যান ওয়াইজ’।

Advertisement

বাবার সংগ্রহ থেকেই শমীক পেয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথের বেশ কিছু গ্রন্থের প্রথম সংস্করণ। পেয়েছিলেন ‘প্রবাসী’ পত্রিকায় প্রকাশিত ‘রক্তকরবী’ নাটক, যা গ্রন্থকার পায় কয়েক বছর পরে। ‘রক্তকরবী’-র ইংরেজি অনুবাদ ‘দি রেড ওলিয়েন্ডার’ প্রকাশিত হয় ‘বিশ্বভারতী কোয়ার্টারলি’-তে। সেই পত্রিকাও থাকছে এই সংগ্রহে। নিজের বই সংগ্রহের অভিজ্ঞতা বলতে গিয়ে শমীক ফিরে গেলেন আশির দশকের মাঝামাঝি সময়ে। ১৯৮৫ সালে ইংরেজ নাট্য ও চিত্রপরিচালক পিটার ব্রুক ভারতে আসেন তাঁর সম্ভাব্য প্রযোজনা ‘মহাভারত’ সংক্রান্ত তথ্যসংগ্রহে ও আনুষঙ্গিক কাজে। শমীক পিটারকে সন্ধান দেন ওড়িশার সরাইকেলার ছো নাচের মধ্যে ধরে রাখা মহাভারত-কাহিনির। সেই নাচের সন্ধানে তাঁরা সরাইকেলা যান। সঙ্গে পিটারের নাটকের জাপানি সঙ্গীত পরিচালক তোশি সুচিহিতোরি এবং অন্যতম নাট্যকার জাঁ-ক্লদ কারিয়ের। সেখান থেকে ফেরার পথে একটা ধাবায় বিশ্রাম নিচ্ছিলেন সকলে। সেই অবসরে শমীক পিটারের সামনে তুলে ধরেন তাঁর কেনা পিটারেরই লেখা নাট্যভাবনা সংক্রান্ত বই ‘দি এম্পটি স্পেস’। সেই বইয়ে পিটার লিখে দেন পুরো এক পাতা জোড়া এক অভিজ্ঞানবাণী।

ছবি সৌজন্য: বই বৈভব ফাউন্ডেশন। চিত্রগ্রাহক: কোয়েলা

১৯৮৫ সালেই ন’ঘণ্টা দৈর্ঘ্যের নাটক হিসেবে মঞ্চস্থ হয় ‘মহাভারত’। ১৯৮৯ সালে পিটারের পরিচালনাতেই ‘মহাভারত’-এর চলচ্চিত্রায়িত রূপ মুক্তি পায়। সেই সঙ্গে বই হিসেবে প্রকাশিত হয় কারিয়েরের লেখা চিত্রনাট্যটিও। কারিয়ের ভারতে এলে সেই বই শমীক নিয়ে যান স্বাক্ষরের জন্য। স্বাক্ষর তো করেছিলেনই কারিয়ের, সইয়ের উপরে দক্ষ হাতে এঁকে দিয়েছিলেন মহাভারতকে কলমে ধরে রাখা গণেশের ছবি। এ ভাবেই বিভিন্ন বইয়ের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কাহিনিকে, তাদের খুঁজে পাওয়ার আখ্যানকে নিজের কণ্ঠে ধরে রাখবেন সংগ্রাহক শমীক। যথাযথ ‘ক্যাটালগিং’-এর পর এই গ্রন্থাগারে এলে পাঠক শুনতে পারবেন সেই সব অনুষঙ্গ। ‘ক্যাটালগিং’ ও সংরক্ষণের ভার শমীক দিয়েছেন ‘বই বৈভব ফাউন্ডেশন’ নামে এক স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার হাতে। তাঁরা সেই কাজের জন্য এবং বইগুলির উপযুক্ত আবাস সংস্থানের জন্য অর্থসংগ্রহও শুরু করেছেন। সংস্থার পক্ষ থেকে রাজু রমণ বললেন, ‘‘কম-বেশি দেড় বছর সময় লেগে যেতে পারে ক্যাটালগিংয়ের কাজে। সঙ্গে চলবে আধুনিক প্রযুক্তিতে শমীকের কণ্ঠস্বরে বই-বৃত্তান্ত ধরে রাখার কাজও।’’

শিল্পকলা থেকে সমাজবাদ, সিনেমা-থিয়েটার থেকে সাহিত্য-দর্শন, বিবিধ বিষয়ে আগ্রহী শমীক তিলে তিলে গড়ে তুলেছিলেন এই বিপুল সংগ্রহ। সময়ের সঙ্গে যাতে তা হারিয়ে না যায়, ভবিষ্যতের পাঠক যাতে মনে রাখেন একেকটি বইয়ের যাত্রারেখাকে, তাই এই অভিনব পরিকল্পনা। আগামী এখানে মুখোমুখি হতে পারবে অতীতের। অতীত সত্যি সত্যি ‘কথা বলবে’ অনন্ত ভবিষ্যতের সঙ্গে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন