সাঁতরাগাছি সেতুর অবস্থা।
২ নভেম্বর, সকাল ১০টা। সেতু থেকে নামার সময়ে হাওড়ামুখী একটি গাড়ির সঙ্গে ট্রাম কোম্পানির একটি বাসের মুখোমুখি সংঘর্ষে গুরুতর আহত হলেন গাড়ির চালক। আহতের নাম সঞ্জয় সিকদার। বাড়ি নিউ ব্যারাকপুরে। জখম যুবককে আশঙ্কাজনক অবস্থায় হাওড়া জেলা হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। হাসপাতাল সূত্রে খবর, ওই যুবকের দু’টি পা গুরুতর ভাবে জখম।
৩০ অক্টোবর, সকাল সাড়ে ৮টা। সেতুতে মালবোঝাই আঠেরো চাকার একটি ট্রেলার খারাপ হয়ে যায়। ফলে কার্যত বন্ধ হয়ে যায় সেতুর এক দিকের যানচলাচল। পুলিশ জানায়, প্রথমে একটি ব্রেক ডাউন ভ্যান ট্রেলারটিকে সরানোর চেষ্টা করে। কিন্তু তাতে কাজ না হওয়ায় জাতীয় সড়ক কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে নিয়ে যাওয়া হয় বিশেষ ধরনের ব্রেক ডাউন ভ্যান। সেই ভ্যান দিয়ে ট্রেলার সরায় পুলিশ। তত ক্ষণে কেটে গিয়েছে দেড় ঘণ্টা। হাওড়ামুখী সব যানবাহন আটকে সেতুর উপরে। লোকজন বাস থেকে নেমে হাঁটতে থাকেন গন্তব্যের দিকে।
৩০ অক্টোবর, সকাল ৯টা। বাবার সঙ্গে মোটরবাইকে চেপে কলকাতার স্কুলে যাচ্ছিল অষ্টম শ্রেণির শুভঙ্কর আগুয়ান। সেতু থেকে নামার পরে জানা গেটের কাছে একটি লরি পিছন থেকে মোটরবাইকটিকে ধাক্কা মারে। মোটরবাইক থেকে রাস্তায় ছিটকে পড়ে ওই ছাত্র। সেই সময়ে উল্টো দিক থেকে আসা একটি লরি শুভঙ্করকে ধাক্কা মেরে বেরিয়ে যায়। মৃত্যু হয় শুভঙ্করের। লরিচালককে গ্রেফতারের দাবিতে পথ অবরোধ করে বিক্ষোভ দেখায় জনতা। দ্বিতীয় সেতুর টোলপ্লাজা থেকে অঙ্কুরহাটি মোড় পর্যন্ত গোটা রাস্তা যানজটের কবলে পড়ে।
২০ অক্টোবর, সপ্তমীর বিকেল সাড়ে ৪টে। হাওড়ার দিক থেকে আসা একটি বাসের সঙ্গে মুখোমুখি সংঘর্ষ হয় অভিনেতা পীযূষ গঙ্গোপাধ্যায়ের গাড়ির। গাড়ি চালাচ্ছিলেন পীযূষবাবুই। এই দুর্ঘটনায় গুরুতর আহত হন তিনি। পীযূষবাবুকে প্রথমে হাওড়া জেলা হাসপাতালে ও পরে কলকাতার একটি বেসরকারি হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। পরে সেখানে তাঁর মৃত্যু হয়।
সেতুর নাম সাঁতরাগাছি সেতু। কলকাতা থেকে দিল্লি রোড এবং মুম্বই রোড যাওয়ার গুরুত্বপূর্ণ সংযোগ পথ। সেতু নির্মাণে বাঙালির অপরিণত মস্তিষ্কের আর একটি ফসল। ১৯৯২ সালে দ্বিতীয় হুগলি সেতুর সঙ্গে চালু হয় সেতুটি। শুরু থেকেই মানুষের ভোগান্তি শুরু। পরবর্তী কালে দিল্লি রোড ও মুম্বই রোডের সংস্কারের পরে হাইওয়েতে যখন ঘণ্টায় ৭০-৮০ কিলোমিটার বেগে গাড়ি চলতে শুরু করে, তখনই এই সেতুর নির্মাণ ও পরিকল্পনার গলদটি সামনে এসে পড়ে। কিন্তু ২৩ বছরেও ওই সেতুটির নক্শায় কোনও পরিবর্তন আনা হয়নি। বাস ও ট্রাক চালকদের অনেকের কাছেই কোনা এক্সপ্রেসওয়ের মরণফাঁদ তাই এই সাঁতরাগাছি সেতু।
কী ছিল পরিকল্পনা
কেএমডিএ সূত্রে খবর, আশির দশকে সাঁতরাগাছি সেতু তৈরির সময়ে পরিকল্পনা হয়েছিল, সেটি ছয় লেনের হবে। কিন্তু তৈরি হওয়ার পরে দেখা যায়, আসলে হয়েছে তিন লেনের একটি সেতু। রাজ্যের পরিবহণ দফতরের প্রাক্তন এক কর্তা জানান, ওই সেতুতে প্রায়ই যে দুর্ঘটনা ঘটছে, তার প্রধান কারণ ওই তিন লেন। রাজ্য পরিবহণ দফতরের ওই কর্তা জানান, কোনা এক্সপ্রেসওয়ে তৈরি হওয়ার সময়ে প্রথমে রাস্তার কাজ করেছিল হাওড়া ইমপ্রুভমেন্ট ট্রাস্ট বা এইচআইটি। ওই সংস্থা সেতুর দু’পাশের রাস্তা করে ছেড়ে দিয়েছিল। কারণ মাঝের অংশ করার কথা রেলের। কিন্তু রেলের সবুজ সঙ্কেত না পাওয়ায় কাজ বন্ধ ছিল প্রায় ১০ বছর। এর পরে যখন সবুজ সঙ্কেত মিলল, তখন তড়িঘড়ি রেলের একটা সেতু নির্মাণকারী সংস্থাকে দিয়ে সাঁতরাগাছি সেতুর মাঝখানের অংশ তৈরি করার সিদ্ধান্ত নেয় কেএমডিএ। সমস্যা শুরু সেখান থেকেই। সেতু ছয় লেনের বদলে তিন লেন হয়ে গিয়েছিল। কেন তিন লেন হল, সেই প্রশ্নের জবাব ছাড়াই সেতুটি তড়িঘড়ি উদ্বোধন করে দেওয়া হয়। ঠিক যেমনটি ঘটেছে কলকাতার সদ্য নির্মিত পরমা উড়ালপুলের ক্ষেত্রেও।
রাজ্যের ট্রাফিক বিভাগের যাবতীয় নক্শা ও পরিকল্পনার দায়িত্বে থাকা রাজ্যের এক প্রাক্তন পরিবহণ কর্তার মতে, সেতুটি তিন লেনের হওয়ায় সেতু নির্মাণকারী সংস্থা সেতুতে কোনও মিডিয়ান বা ডিভাইডার যেমন রাখতে পারেনি, তেমনই পথচারীদের জন্য ফুটপাথও করতে পারেনি। ফলে সমস্যা আরও বেড়েছে। পাশাপাশি, সাঁতরাগাছি সেতু থেকে বিদ্যাসাগর সেতুর দিকে যাওয়া বা বিপরীতে যাওয়ার সময়ে গাড়িগুলি সেতুতে উঠে চার লেন থেকে তিন লেনে গিয়ে পড়ে। ফলে একটি লেনের অভাব সেতুর শেষ প্রান্তে না যাওয়া পর্যন্ত থেকেই যায়। এর উপরে রয়েছে বড় গাড়ি যেমন বাস, লরি, ট্রেলারের বেপরোয়া গতি। তারা উল্টো দিকের ছোট গাড়িগুলিকে এক দিকে এমন ভাবে চেপে দেয় যে সেগুলির চালকেরা অনেক ক্ষেত্রেই নিয়ন্ত্রণ রাখতে পারেন না।
দুর্ঘটনার আঁতুড় ঘর
রাজ্যের রোড সেফটি কাউন্সিল রাজ্যের যে ২৫টি জায়গাকে দুর্ঘটনার নিরিখে ‘ব্ল্যাকস্পট’ হিসেবে চিহ্নিত করেছিল, ঘটনাচক্রে সেই তালিকায় প্রথম তিনের মধ্যেই জায়গা করে নিয়েছে সাঁতরাগাছি সেতু। পুলিশের হিসেব বলছে, সাঁতরাগাছি সেতুর উপরে ২০১৪-এ দুর্ঘটনা ঘটেছে ২০টি। মৃত্যু হয়েছে ৪ জনের, গুরুতর জখম ১০ জন। চলতি বছরে গত ছ’মাসেই ২৪টি দুর্ঘটনার সাক্ষী হয়েছে সাঁতরাগাছি সেতু। মৃত্যু হয়েছে ৫ জনের, জখম ১০ জন।
হাওড়া সিটি পুলিশের কর্তারা জানাচ্ছেন, সেতুর মাঝামাঝি এলাকা আচমকা উঁচু হয়ে যাওয়ায় বড় গাড়ি প্রায়ই ওই এলাকা পেরোতে গিয়ে ‘ব্রেক ডাউন’ হয়ে যায়। তার জেরে সেতু জুড়ে কার্যত নৈরাজ্য তৈরি হয়। নিত্য দিনের ওই ঘটনা সামাল দিতে হিমশিম খেতে হয় পুলিশকে। এমনকী, সর্বদা খারাপ হওয়া ট্রাক ও ট্রেলারের জন্য পুলিশ কিয়স্কে ডিজেল মজুত রাখতে হয়।
মানুষও সচেতন নয়
এই সেতুতে দুর্ঘটনার প্রবণতা বাড়িয়েছে মানুষই। সেতুতে ওঠানামার মুখে ট্রাফিকের লাল সিগন্যাল ভেঙেই রাস্তা পারাপার করে সাইকেল, স্কুটার, মোটরবাইক। সেতুটি পথচারীদের জন্য নয় জেনেও কেউ কেউ উঠে পড়েন সেতুতে। রাস্তার ধার ঘেঁষে হাঁটতে থাকেন। সাইকেল পুলিশের সামনেই সেতুতে ওঠে। মাল নিয়ে সেতু পেরোয় রিকশা ভ্যান। এক দূরপাল্লার বাস চালকের অভিজ্ঞতা, ‘‘আাসানসোল থেকে কলকাতায় আসার পথে দু’টি জায়গায় সাবধানে চালাতে হয়। পানাগড় আর সাঁতরাগাছি সেতু। সেতুতে ওঠার মুখে ও সেতুর উপরে অনেকটা সময় নষ্ট করে নামার সময়ে সবাই-ই গতি বাড়িয়ে সময় বাঁচাতে চায়। আর তখনই দুর্ঘটনা ঘটে। সামনে হঠাৎ সাইকেল, রিকশা ভ্যান বা পথচারী চলে এলে আর গতি রোখা সম্ভব হয় না।’’
ঘোষণাই সার
অভিনেতা পীযূষ গঙ্গোপাধ্যায় সাঁতরাগাছি সেতুতে যেখানে দুর্ঘটনার কবলে পড়েছিলেন, সেখানে কয়েকদিন আগে বেলুড় আসা-যাওয়ার পথে গাড়ি থেকে নেমে পড়েছিলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। দুর্ঘটনা রুখতে তিনি কোনা এক্সপ্রেসওয়ে জুড়ে পাবলিক অ্যাড্রেস সিস্টেম, পথচারীদের জন্য বিকল্প রাস্তা তৈরি করা, সাঁতরাগাছি সেতু থেকে বাস টার্মিনাস পর্যন্ত ক্লোজ সার্কিট ক্যামেরায় মুড়ে দেওয়া, রাস্তার দু’ধারে বেআইনি পার্কিং অবিলম্বে তুলে দেওয়ার ও সেতুটির রাস্তা অবিলম্বে মেরামত করার নির্দেশ দিয়েছিলেন। ওই ঘোষণার পরে সাত দিন পেরিয়ে গেলেও এখনও কিছুই হয়নি। কবে হবে, সে ব্যাপারে কোনও নির্দেশও নবান্ন থেকে আসেনি হাওড়া জেলা প্রশাসনের কাছে।
ছবি: প্রদীপ আদক ও নিজস্ব চিত্র।