আবৃত: পুজোর বিজ্ঞাপনে মুখ ঢাকতে শুরু করেছে শহরের। বৃহস্পতিবার, হাজরা মোড়ে। নিজস্ব চিত্র
খোলা বারান্দায় বসে রাস্তা দিয়ে মানুষের চলাচল দেখবেন। গাড়ি-ঘোড়া দেখবেন। অবসর সময়ের অনেকটাই কেটে যাবে এ ভাবে আরাম কেদারায় বসে। ঘরে আলো-হাওয়াও খেলবে। এ সব ভেবেই দক্ষিণ কলকাতার লেক এলাকায় ৯০ লক্ষ টাকা দিয়ে রাস্তার ধারে ফ্ল্যাট কিনেছিলেন অবসরপ্রাপ্ত কর্পোরেট কর্তা চিরঞ্জীব রায়।
কিন্তু তিন বছরেই তাঁর পালাই পালাই দশা। হবে না-ই বা কেন, অগস্ট মাস থেকেই বাড়ির সামনে ফুটপাথ ঘেঁষে বাঁশের খাঁচা বাঁধা শুরু। প্রথমে চোখের সামনে থেকে হারিয়ে যেতে থাকে সামনের রাস্তা। পরে আকাশও। আর পুজোর ১৫ দিন আগে সেই বাঁশের খাঁচায় সারি সারি হোর্ডিং লেগে যায়। তখন তো বাড়িতে আর আলোও ঢোকে না। আত্মীয়-বন্ধুদের কাছে চিরঞ্জীববাবু বলে রেখেছেন, ‘‘নতুন ফ্ল্যাট দেখো। আর এমন জায়গায় দেখো, যা ত্রিসীমানায় কোনও পুজো নেই!’’
সমস্যাটা চিরঞ্জীববাবুর একার নয়। শহরে যেখানে যেখানে বড় পুজো হয় সেখানকার বাসিন্দাদের অনেককেই পুজোর দু’টি মাস এমন অন্ধকূপে থাকতে হয়। উৎসবের শহরে আলোর সাজ চেনা। কিন্তু গত কয়েক বছর ধরে যেন রাস্তার হোর্ডিং, ব্যানারের বিজ্ঞাপনেই পুজো টের পাওয়া যায়। এবং সেই ব্যানার-হোর্ডিংয়ের দাপট এমনই, যে ফুটপাথ, দোকান, বাড়ি সব ঢেকে যায়। উৎসবের সময় শহরের সেজে ওঠাটা স্বাভাবিক। কিন্তু তা করতে গিয়ে মানুষের অধিকার হরণ তো বটেই, বিষয়টা দৃশ্য দূষণের পর্যায়ে চলে যাচ্ছে কি না, সেই প্রশ্ন তুলেছেন পরিবেশবিদেরা।
রাস্তায় হোর্ডিং-ব্যানারে বিজ্ঞাপন দিলে সংশ্লিষ্ট পুরসভাকে নির্দিষ্ট হারে কর দিতে হয়। তা হলে কি শুধু রাজস্ব বাড়ানোর জন্যই পুজোর সময় হোর্ডিং-ব্যানারের সংখ্যা লাগামছাড়া ভাবে বাড়ানোর অনুমতি দিচ্ছে পুরসভা? কলকাতা পুরসভা সূত্রের বক্তব্য, পুজোর বিজ্ঞাপন-ব্যানার থেকে এক পয়সাও আয় হয় না তাদের। কারণ মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় পুজোর হোর্ডিং-ব্যানার থেকে কর আদায় বন্ধ করে দিয়েছেন।
শুধু তা-ই নয়, পুরসভার আশঙ্কা এ বছর হোর্ডিং-ব্যানারের সংখ্যা আরও বাড়তে পারে। কারণ এ বছর পুজো মিটতে না-মিটতেই শহরে অনূর্ধ্ব-১৭ ফুটবল বিশ্বকাপ শুরু হচ্ছে। মুখ্যমন্ত্রী পুজো কমিটিগুলির কাছে আবেদন রেখেছেন, যেন পুজোর পাশাপাশি ফুটবল বিশ্বকাপেরও প্রচার করে।
পুজো এলেই শহর ও শহরতলির ক্ষেত্রে সত্যি হয়ে ওঠে শঙ্খ ঘোষের বিখ্যাত কবিতা— ‘মুখ ঢেকে যায় বিজ্ঞাপনে’। হাতিবাগান এলাকার কথাই ধরা যাক। বৈশাখ মাস থেকেই সেখানে হোর্ডিং পড়ে গিয়েছে।
কোন পুজোয় কোন শিল্পী, থিমের চমক কী— সবই ঘোষণা চলছে এ ভাবে! একই অবস্থা শ্যামবাজার, গড়িয়াহাট, পাতিপুকুরেও। ওই সব এলাকার বাসিন্দারা বলছেন, উৎসব যত এগিয়ে আসবে, ততই বাড়বে হোর্ডিং।
এখন তো সবে পুজো কমিটিগুলির বিজ্ঞাপন রয়েছে, এ বার জুটবে স্পনসরদের বিজ্ঞাপনও।
পুজোয় বাহারি থিমে শহরকে সাজিয়ে তোলে পুজো কমিটিগুলি। কে কত সুন্দর, তারও টক্কর চলে। কিন্তু শহরের এমন দমবন্ধ হাল কেন?
এই অভিযোগ মানতে নারাজ পুজো কমিটিগুলি। উত্তর কলকাতার একটি পুজো কমিটির কর্তা বলছেন, ‘‘এখন আর চাঁদা তুলে পুজো করা সম্ভব নয়। তাই স্পনসরের টাকাতেই পুজো হয়। টাকা নিলে বিজ্ঞাপন না-দিয়ে উপায় কী?’’ লেক এলাকার এক পুজোকর্তা সাফাই দিলেন, বছর-বছর পুজোর খরচ, আ়ড়ম্বর বাড়ছে। তাই টাকা জোগাড়ে সব পুজো কমিটিই বেশি বেশি করে স্পনসর ধরছে। বা়ড়ছে বিজ্ঞাপনের বহরও। ‘‘তা ছাড়া রংবাহারি ব্যানার, হোর্ডিং, ফ্লেক্সে রাস্তার ধারে বহু মলিন বাড়িঘর ঢাকা পড়ে যায়। উৎসবের সময় ভাঙাচোরা বাড়ি দেখতে কি ভাল লাগে?’’
পূর্ব কলকাতার একটি নামী পুজোর কর্মকর্তার বক্তব্য, ‘‘হোর্ডিং, ব্যানার লাগানো হয় রাস্তায়। কারও বা়ড়িতে লাগানো হয় না। রাস্তায় ব্যানার লাগানোর ক্ষেত্রে পুরসভার আইন রয়েছে। তার পরেও যদি কারও বাড়ির সামনে লাগানো হয়, তা হলে সংশ্লিষ্ট গৃহস্থের অনুমতিও নেওয়া হয়।’’ কিন্তু নাগরিকদের অনেকেরই আবার পাল্টা বক্তব্য, অনুমতি না দিয়ে উপায় কী? কে জলে থেকে কুমিরের সঙ্গে লড়তে যাবে?
বহু ক্ষেত্রে পুজো মিটে যাওয়ার পরেও হোর্ডিং খোলা হয় না। সে ক্ষেত্রে পুরসভাই সে সব সরিয়ে ফেলার ব্যবস্থা করে। এ বছর অবশ্য মুখ্যমন্ত্রী জানিয়ে দিয়েছেন, আগামী
৫ অক্টোবরের মধ্যে সব ব্যানার, হোর্ডিং খুলে ফেলতে হবে। তবে এ ভাবে সাধারণ মানুষের বাড়ির জানালা, বারান্দা রুদ্ধ করে হোর্ডিং লাগানো কেন বন্ধ হবে না, সেই প্রশ্ন তুলেছেন চিরঞ্জীববাবুদের মতো অনেকেই। পুরসভার কাছে এই প্রশ্নের জবাব নেই।