ডাম্বেলে মাথা থেঁতলে দিয়ে বাবাকে খুন স্কিৎজোফ্রেনিক ছেলের

শনিবার দুপুরে এমন দৃশ্য দেখে চিৎকার করে ওঠেন আতঙ্কে দিশাহারা সুতপাদেবী। তা শুনে ছুটে আসেন প্রতিবেশীরা। তত ক্ষণে নিথর হয়ে গিয়েছেন শুভাশিসবাবু। রক্তাক্ত ডাম্বেল হাতে স্থবির হয়ে দাঁড়িয়ে অর্ণব। পুলিশ জানায়, পঞ্চসায়র এলাকায় বেলা আড়াইটে নাগাদ ওই ঘটনা ঘটে।

Advertisement

নিজস্ব সংবাদদাতা

শেষ আপডেট: ১৭ সেপ্টেম্বর ২০১৭ ০১:২৬
Share:

ভয়াবহ: ডাম্বেল দিয়ে এখানেই বাবাকে খুন করেন অর্ণব।

সবেমাত্র দুপুরের খাওয়া শেষ হয়েছে। শোয়ার ঘরে বিশ্রামের তোড়জো়ড় করছিলেন অবসরপ্রাপ্ত ব্যাঙ্ককর্তা শুভাশিস সান্যাল। আচমকাই তাঁর আর্ত চিৎকার ভেসে আসে স্ত্রী সুতপাদেবীর কানে। ছুটে গিয়ে তিনি দেখেন, ডাম্বেল দিয়ে বাবার মাথা থেঁতলে দিচ্ছে ছেলে অর্ণব! চোখেমুখে অস্বাভাবিক হিংস্রতা।

Advertisement

শনিবার দুপুরে এমন দৃশ্য দেখে চিৎকার করে ওঠেন আতঙ্কে দিশাহারা সুতপাদেবী। তা শুনে ছুটে আসেন প্রতিবেশীরা। তত ক্ষণে নিথর হয়ে গিয়েছেন শুভাশিসবাবু। রক্তাক্ত ডাম্বেল হাতে স্থবির হয়ে দাঁড়িয়ে অর্ণব। পুলিশ জানায়, পঞ্চসায়র এলাকায় বেলা আড়াইটে নাগাদ ওই ঘটনা ঘটে। শুভাশিসবাবুকে (৬০) হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হলে মৃত ঘোষণা করা হয়। খুনের অভিযোগে অর্ণবকে গ্রেফতার করা হয়েছে। বাজেয়াপ্ত করা হয়েছে ডাম্বেলটি। সুতপাদেবীর পরিবারের দাবি, আঠাশ বছরের অর্ণব বছর তিনেক ধরে স্কিৎজোফ্রেনিয়ায় ভুগছে। সেই কারণেই মাঝপথে পড়াশোনা ছেড়ে দিয়েছিল সে।

প্রাথমিক তদন্তে পুলিশ জেনেছে, মাঝপথে পড়াশোনা ছাড়লেও সম্প্রতি ফের কলেজে ভর্তি হতে চেয়েছিল অর্ণব। রাজস্থানের একটি কলেজ খুঁজে বার করেছিল। কিন্তু অসুস্থ অবস্থায় কলেজে ভর্তি করানো উচিত হবে কি না, তা নিয়ে ধন্দে ছিলেন শুভাশিসবাবু। তা নিয়ে গত কয়েক দিনে একাধিক বার বাবা ও ছেলের কথা কাটাকাটি হয়েছিল। শুভাশিসবাবুর পরিজনেরা জানিয়েছেন, মানসিক রোগে আক্রান্ত হওয়ার পর থেকে বাড়িতেই থাকত অর্ণব। কারও সঙ্গে মেলামেশা করত না। নানা বিষয়ে মাঝেমধ্যে অশান্ত হয়ে উঠলেও এতটা হিংস্র হতে কোনও দিন দেখা যায়নি তাকে। সুতপাদেবীর সঙ্গে কথা বলে আত্মীয়েরা জেনেছেন, এমন কাণ্ড যে অর্ণব ঘটাতে পারে,
তা পাঁচ মিনিট আগেও বুঝতে পারেননি তিনি।

Advertisement

শুভাশিস সান্যাল। শোকস্তব্ধ সুতপাদেবী। শনিবার। ছবি: দেবস্মিতা ভট্টাচার্য

ওই পরিবারের আত্মীয়েরা জানান, শুভাশিসবাবু একটি রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কের ম্যানেজার পদে কর্মরত ছিলেন। মাস চারেক আগে অবসর নেন। মেয়ে বিবাহিত। থাকেন লন্ডনে। পঞ্চসায়রের বাড়িতে স্ত্রী ও ছেলেকে নিয়ে থাকতেন শুভাশিসবাবু। অর্ণব ডায়মন্ড হারবারের একটি ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে ইলেকট্রনিক্স ও টেলিকম প্রযুক্তি নিয়ে স্নাতক স্তরে ভর্তি হয়েছিল। হস্টেলেই থাকত। ২০১৪ সালে মানসিক রোগ ধরা প়ড়ে তার। পড়া ছেড়ে বাড়িতে ফিরে এসেছিল সে। সান্যাল পরিবারের আত্মীয় তপন মুখোপাধ্যায় জানান, মানসিক রোগের কারণে হাসপাতালে ভর্তি করানো হয়েছিল অর্ণবকে। হাসপাতাল থেকে ছা়ড়া পাওয়ার পরেও চিকিৎসা চলছিল। নিয়মিত ওষুধ খেতে হতো তাকে। বাড়িতেই ডাম্বেল নিয়ে শরীরচর্চা করত। ‘‘সেই ডাম্বেল দিয়েই যে বাবার প্রাণ কে়ড়ে নেবে ও, এমনটা ভাবতে পারিনি। ছোট থেকে ওকে দেখছি। অসুস্থ হওয়ার পরে মেলামেশা কমিয়ে দিলেও ওকে হিংস্র হয়ে উঠতে দেখা যায়নি,’’ বলছেন ওই এলাকার এক বাসিন্দা।

অর্ণব তাঁর বাবাকে পরিকল্পনা করে খুন করেনি বলেই মনে করছেন মনোরোগ চিকিৎসক ও মনস্তত্ত্ববিদেরা। মনস্তত্ত্ববিদ নীলাঞ্জনা সান্যালের মতে, ‘‘স্কিৎজোফ্রেনিয়ার রোগীরা বাস্তববিমুখ এবং প্রবল রকম কল্পনাপ্রবণ হন। কোনও কিছু মাথায় এলে তখনই তা পাওয়ার জন্য অস্থির হয়ে ওঠেন। না পেলে হিতাহিত জ্ঞান থাকে না। ওই যুবকের আচরণ পূর্বপরিকল্পিত নয় বলেই মনে হয়। নিজের চাহিদা পূরণ না হওয়ার ফলেই রাগের চোটে এমন কাণ্ড ঘটিয়েছেন তিনি।’’ ইনস্টিটিউট অব সাইকায়াট্রি-র ক্লিনিক্যাল সাইকোলজি-র শিক্ষক প্রশান্তকুমার রায় বলছেন, ‘‘স্কিৎজোফ্রেনিয়ায় আক্রান্তদের মধ্যে আচমকা রেগে যাওয়া বা কোনও ক্ষতিকর কিছু
ঘটিয়ে ফেলার প্রবণতা থাকে। বাস্তব সম্পর্কে বোধ কম থাকে বলে এমন আচরণ করতে পারে।’’ মনোরোগ চিকিৎসক সুজিত সরখেলের মতে, ‘‘এই ধরনের রোগীরা দিগ্বিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে নিজের ক্ষতিও করে ফেলতে পারেন। এঁদের সামনে থেকে ধারালো বা অস্ত্র গোছের জিনিস সরিয়ে রাখাটাই ভাল। এঁদের সঙ্গে তর্কে জড়ানো ঠিক নয়। তবে নিয়মিত, সঠিক চিকিৎসায় কিন্তু এই রোগকে নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন