কলকাতা জাদুঘরে প্রাচীন মুদ্রায় চোখ দর্শনার্থীর। —নিজস্ব চিত্র।
কলকাতার লন্ডন হওয়ার কথা ছিল। কলকাতা কি প্যারিস হতে পারে?
মাত্র সাত মিনিটে প্যারিসের লুভ্র জাদুঘর থেকে প্রায় ৯০০ কোটি টাকার সম্পদ হাতিয়ে পালিয়েছে দুষ্কৃতীরা। নিরাপত্তারক্ষীদের নড়াচড়ার সময়টুকুও দেয়নি। কলকাতায় রয়েছে এশিয়ার প্রাচীনতম এবং বৃহত্তম জাদুঘর। তার নিরাপত্তা ব্যবস্থা কেমন? প্যারিসের লুভ্রের মতো কোনও ঘটনা ঘটতে পারে কলকাতায়?
সরেজমিনে খোঁজ নিয়ে দেখা গেল, জাদুঘরের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই) প্রযুক্তি ব্যবহার করতে চলেছেন কর্তৃপক্ষ। সেই প্রস্তুতি শুরুও হয়ে গিয়েছে।
একতলার বারান্দা থেকে কলকাতা জাদুঘর প্রাঙ্গন। —নিজস্ব চিত্র।
কলকাতা জাদুঘরে শেষ বার চুরি হয়েছিল ২১ বছর আগে, ২০০৪ সালে। চুরি হয়েছিল একটি দুর্লভ বুদ্ধমূর্তি। সেটির অন্তর্ধান এখনও রহস্য, যার কোনও কিনারা হয়নি। এখন জাদুঘরে মোট ৩৫টি গ্যালারি রয়েছে। সেখানে রয়েছে সম্রাট শাহজাহানের সোনা ও রুবি দিয়ে মোড়া সুরাপাত্র থেকে শুরু করে মিশরের মমি, সমুদ্রগুপ্তের স্বর্ণমুদ্রা, অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জলছবির মতো বিভিন্ন দুর্মূল্য প্রাচীন সাংস্কৃতিক ও ঐতিহাসিক নিদর্শন। সোমবার ছাড়া সপ্তাহের অন্যান্য দিন আট ঘণ্টা করে দর্শকদের জন্য জাদুঘর খোলা থাকে।
এই জাদুঘরে কি তস্করদের ঢুকে পড়ে মূল্যবান সামগ্রী নিয়ে উধাও হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা একেবারেই নেই?
কর্তৃপক্ষের দাবি, জাদুঘরে এখন ৭০০-রও বেশি সিসি ক্যামেরা রয়েছে। প্রতিটিই ‘বিশেষ ক্ষমতাসম্পন্ন’। যে কোনও রকমের নড়াচড়া এই ক্যামেরাগুলিতে ধরা পড়ে (পরিভাষায় ‘মোশন ডিটেক্ট’) এবং সেই নড়াচড়া সম্পর্কে ক্যামেরাগুলি আলাদা সতর্কবার্তা পাঠায়। তবে নিরাপত্তা ব্যবস্থা আরও উন্নত করতে ওই সিসি ক্যামেরায় কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা প্রয়োগের পরিকল্পনা করেছেন কর্তৃপক্ষ। যার আনুমানিক খরচ কয়েক কোটি টাকা। জাদুঘরের ডিরেক্টর অরিজিৎ দত্ত চৌধুরী বলেন, ‘‘আমাদের সব সিসিটিভি-ই বিশেষ ক্ষমতাসম্পন্ন। গতিবিধি শনাক্ত করা যায়। কিন্তু আমরা সেই ক্যামেরায় এআই ব্যবহার করব। শুধু মানুষের গতিবিধিই ক্যামেরার মাধ্যমে শনাক্ত করতে এআই প্রয়োজন। যাতে রাতবিরেতে কুকুর-বিড়ালের চলাফেরায় বিপদঘন্টি না বেজে ওঠে। নতুন প্রযুক্তি কাজে লাগিয়ে কী ভাবে নিরাপত্তাজনিত সীমাবদ্ধতা অতিক্রম করা যায়, সেটাই আমরা দেখছি।’’
—নিজস্ব চিত্র।
লুভ্রের ঘটনার পরেই কি এই ‘তৎপরতা’? অরিজিৎ তা মানতে চাননি। তিনি জানিয়েছেন, লুভ্রের ঘটনার পর জাদুঘরের নিরাপত্তা নিয়ে আলাদা করে আলোচনা হয়েছে ঠিকই, তবে তার আগে থেকেই এআই নিয়ে তৎপরতা শুরু হয়েছিল। নিরাপত্তার স্বার্থে এআই ক্যামেরার বিষয়টি এর বেশি খোলসা করতে চাননি জাদুঘরের ডিরেক্টর।
কলকাতা জাদুঘর একটি জাতীয় সম্পত্তি। তার দায়দায়িত্ব এবং রক্ষণাবেক্ষণের ভার কেন্দ্রীয় সরকারের। এই জাদুঘরের নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকেন কেন্দ্রীয় বাহিনীর ৫৭ জন জওয়ান (সিআইএসএফ)। তা ছা়ড়াও জাদুঘর কর্তৃপক্ষ আলাদা করে আরও ৪০ জন নিরাপত্তারক্ষী নিয়োগ করেছেন। প্রতি গ্যালারিতে নজরদারির জন্য কর্মী রয়েছেন। ওয়াকিটকির মাধ্যমে তাঁরা নিজেদের মধ্যে যোগাযোগ রাখেন। জাদুঘরে প্রবেশের সময় নির্দিষ্ট প্রযুক্তি ব্যবহার করে স্ক্যানিংয়ের বন্দোবস্ত রয়েছে।
কলকাতা জাদুঘরের সংগ্রহে সম্রাট শাহজাহানের সোনা ও রুবি দিয়ে মোড়া সুরাপাত্র। —নিজস্ব চিত্র।
টিকিট দেখিয়ে, ব্যাগ পরীক্ষা করিয়ে ভিতরে ঢোকার বন্দোবস্ত রয়েছে। সে ভাবেই ভিতরে ঢোকা গেল অন্য দর্শনার্থীদের সঙ্গে। মূল গেটের বাইরে সিআইএসএফ জওয়ানেরা ছিলেন। তবে জাদুঘরের ভিতরে সে ভাবে তাঁদের দেখা মেলেনি। দর্শনার্থীরা অবশ্য নিরাপত্তা নিয়ে তেমন উদ্বিগ্ন নন। প্রয়াগরাজ থেকে ভারতের বৃহত্তম জাদুঘর দেখতে সপরিবার কলকাতায় এসেছেন শামিমা নাজ়। তাঁর কথায়, ‘‘এখানকার নিরাপত্তা ব্যবস্থা ভালই মনে হচ্ছে। তবে জাদুঘরের ভিতরে তেমন কাউকে চোখে পড়েনি। জানি না, অন্য কী ভাবে আমাদের উপর নজর রাখা হচ্ছে।’’ কর্তৃপক্ষের অবশ্য দাবি, নিরাপত্তারক্ষীদের ঘোরাঘুরির চেয়ে কী ভাবে প্রযুক্তিকে নিরাপত্তার কাজে লাগানো যায়, তা নিয়েই তাঁরা বেশি ভাবনাচিন্তা করেন। ডিরেক্টর অরিজিতের কথায়, ‘‘আমাদের কন্ট্রোল রুম আছে। সেখান থেকে পুরো জাদুঘরের নজরদারি চলে।’’
জাদুঘরেই দেখা পাওয়া গেল রাজস্থানের অবসরপ্রাপ্ত পুলিশকর্তা হরলাল সিসৌদিয়ার। তিনি জাদুঘর নিয়ে বিশেষ উৎসাহী। দেশের বিভিন্ন প্রান্তে ঘুরে ঘুরে বিভিন্ন জাদুঘরের সংগ্রহ দেখে বেড়ান। কলকাতার জাদুঘরের নিরাপত্তা নিয়ে তাঁরও খুব একটা অসন্তোষ নেই। তবে অধিকাংশ বহুমূল্য সম্পদ চাক্ষুষ করতে পারেননি বলে কিছুটা হতাশ। বললেন, ‘‘এখানে সিআইএসএফ আছে। এত সিসি ক্যামেরা রয়েছে। নিরাপত্তা নিয়ে চিন্তা নেই। তবে আমরা যে আসল মুদ্রাগুলো দেখতে এসেছিলাম, তার অধিকাংশই দেখতে পেলাম না। আসল মুদ্রাই যখন রাখা হয়নি, তখন আর এত নজরদারির কী প্রয়োজন?’’ যে প্রশ্নে জাদুঘরের ডেপুটি ডিরেক্টর সায়ন ভট্টাচার্য জানিয়েছেন, সাধারণ ভাবে জাদুঘরের মোট সংগ্রহের মাত্র ছ’শতাংশ প্রদর্শন করা হয়। বাকি ৯৪ শতাংশই অন্তরালে থাকে। সেগুলির জন্য আলাদা নজরদারির ব্যবস্থাও রয়েছে।
মাত্র সাত মিনিটে মই বেয়ে লুভ্র জাদুঘরের তিন তলায় উঠে গিয়েছিল চার দুষ্কৃতী। জানলা ভেঙে বহুমূল্য সম্পদ হাতিয়ে বাইকে চড়ে পালিয়ে যায় তারা! নিরাপত্তার বেড়াজাল টপকে রুদ্ধশ্বাস সেই সাত মিনিট গোটা বিশ্বকে নাড়িয়ে দিয়েছে। কলকাতার জাদুঘরেও অনেক সামগ্রী কাচের বাক্সে তালাবন্ধ করে রাখা। ছোট্ট কয়েকটি তালা কি প্রাচীন পাথর সংরক্ষণের জন্য যথেষ্ট? সরাসরি এ প্রশ্নের জবাব দিতে চাননি কর্তৃপক্ষ। অরিজিৎ জানান, জাদুঘরের যে অংশে মূল্যবান প্রাচীন পাথর রাখা, সেই অংশটি জিওলজিক্যাল সার্ভে অফ ইন্ডিয়ার দায়িত্বে। সেখানে কী ভাবে জিনিস রাখা হবে, সে বিষয়ে সিদ্ধান্তও তারাই নিয়ে থাকে। তবে সামগ্রিক নিরাপত্তার দায়িত্ব জাদুঘর কর্তৃপক্ষের।
জাদুঘরে ছোট কাচের ঢাকনাযুক্ত বাক্সে তালাবন্ধ বহুমূল্য পাথর। —নিজস্ব চিত্র।
জাদুঘরে ঢুকে ডান দিকের একটি অংশে এখন কিছু সংস্কারের কাজ চলছে। কর্তৃপক্ষের দাবি, যাঁরা সেই কাজের সঙ্গে যুক্ত, নির্দিষ্ট পদ্ধতি মেনে তাঁদের পরিচয়পত্র যাচাই করে নিয়োগ করা হয়েছে। তবে জাদুঘরের বাইরের ফুটপাথের হকারদের নিয়ে চিন্তা রয়েছে। অরিজিতের কথায়, ‘‘আমাদের বেশি চিন্তা গেটের বাইরের হকারদের নিয়ে। ওই জায়গাটা আমাদের নিয়ন্ত্রণে নেই। ফলে সেখান থেকে কেউ কিছু করলে আমরা আটকাতে পারব না। সেটা নিয়ে পুরসভার সঙ্গে কথা বলেছি। একাধিক বার কলকাতা পুলিশের দৃষ্টি আকর্ষণও করা হয়েছে।’’
জাদুঘর কর্তৃপক্ষের ‘আশ্বাসবাণী’ শুনে মনে হল, কলকাতা থেকে প্যারিস এখনও দূরেই আছে।