Sex Workers

জীবনযুদ্ধের গল্প বড় পর্দায় নিজেরাই বলছেন যৌনকর্মীদের সন্তানেরা

কালীঘাটের যৌনপল্লিতে বেড়ে ওঠা, স্কুলপড়ুয়া খুশির মায়ের আবার চিন্তা বাড়ছে মেয়েকে নিয়ে।কারণ, তাঁর ‘খদ্দেরে’র কুনজর যে পড়েছে মেয়ের দিকেও! তাই যৌনকর্মী মা ভাবেন, মেয়েকে ‘বাঁচাতে’তাকে অন্যত্র সরিয়ে দেওয়া বা বিয়ে দেওয়ার কথা।

স্বাতী মল্লিক

শেষ আপডেট: ১১ অগস্ট ২০২৫ ০৯:৪৭
Share:

—প্রতীকী চিত্র।

মন খারাপ করে ভরসন্ধ্যায়পুকুরপাড়ে বসে বছর আটেকের পিকলু। পাশে মা এসে বসলে সে বলতে থাকে, এ দিনও ক্লাসেপড়া বলতে পারেনি। কারণ, প্রতি সন্ধ্যায় তাদের এক কামরার ঘরেই যে তার যৌনকর্মী মায়ের কাছে আসে ‘খদ্দের’! ফলে পড়া ফেলে বেরিয়ে যেতে হয় পিকলুকে। যৌনকর্মীর সন্তান হওয়ার ‘অপরাধে’ মাঠে ফুটবল খেলাতেও সে ব্রাত্য। তবু তার দু’চোখ ভরা স্বপ্ন— ‘‘মা আমি লেখাপড়া করব, অনেকবড় হব।’’

কালীঘাটের যৌনপল্লিতে বেড়ে ওঠা, স্কুলপড়ুয়া খুশির মায়ের আবার চিন্তা বাড়ছে মেয়েকে নিয়ে। কারণ, তাঁর ‘খদ্দেরে’র কুনজর যে পড়েছে মেয়ের দিকেও! তাই যৌনকর্মী মা ভাবেন, মেয়েকে ‘বাঁচাতে’তাকে অন্যত্র সরিয়ে দেওয়া বা বিয়ে দেওয়ার কথা। গুটিপোকা থেকে আস্তে আস্তে প্রজাপতি হয়ে ওঠা কিশোরীটি আবার ভয়ে কাঁটা হয়ে থাকে— ‘‘মা তুমি আমার বিয়ে দিয়ে দেবে না তো?’’ রাতে ঘরের দরজায় পাড়ার পরিচিত যুবক এলে আতঙ্কে সে বলে, ‘‘দরজা খুলব না, তুমি বাজে ভাবে ছোঁও। চলে না গেলে চিৎকার করব কিন্তু।’’

পিকলু বা খুশি কোনও কাল্পনিক চরিত্র নয়। তারা সোনাগাছি বা কালীঘাটের যৌনপল্লির আনাচেকানাচে বেড়ে ওঠা যৌনকর্মীর সন্তানদেরই প্রতিচ্ছবি। তাদের জীবনযুদ্ধের কাহিনি,হাসি-কান্নার ছোট ছোট মুহূর্তগুলিই ধরা পড়েছে দু’টি স্বল্প দৈর্ঘ্যের সিনেমা ‘খুশি’ ও ‘পিকলু’র মাধ্যমে। বড় পর্দায় সেই বাস্তব ছবিই তুলে ধরেছেন সোনাগাছির যৌনকর্মীদের সন্তানদের সংঠন ‘আমরা পদাতিক’-এর সদস্যেরা। যেখানে চিত্রনাট্য, পরিচালনা, অভিনয়— সবেতেই রয়েছেন যৌনপল্লির সন্তানেরাই।

রবিবার নন্দনে মিনিট কুড়ির সিনেমা দেখতে হল ভরিয়েছিলেন যৌনকর্মী ও তাঁদের সন্তানেরা। সেখানে কখনও বড় পর্দায় নিজেকে দেখে খুশিতে উদ্বেল খুদে অভিনেতারা, কখনও দর্শকাসনে হাসির ফোয়ারা ছুটেছে।

যদিও নির্মাতারা জানাচ্ছেন, সিনেমা করাটা বাস্তবে ততটাও সহজ ছিল না। কখনও কালীঘাটএলাকায় ড্রোন উড়িয়ে ফুটেজ তুলতে গিয়ে, কখনও যৌনপল্লির ভিতরে ক্যামেরা চালিয়ে শুটিং করতেগিয়ে তাঁরা বাধার মুখে পড়েছেন। তবে দমে যাননি কেউই। ‘আমরা পদাতিক’-এর তরফে রতন দলুই বলেন, ‘‘সামাজিক মতাদর্শবদলাতেই এই সিনেমা। সুযোগ পেলে আমরাও সমাজের মূল স্রোতেফিরতে চাই।’’

দু’টি সিনেমার পরিচালক তথা চিত্রনাট্যকার, গল্পকার রবীন বাগ নিজেও এক জন যৌনকর্মীরসন্তান। তাই তিনি বিলক্ষণ জানেন, ‘প্রান্তিক’ থেকে সমাজের মূল স্রোতে ফেরার পথ আদতে কতটা বন্ধুর। আগেও ছোটখাটো কয়েকটিস্বল্প দৈর্ঘ্যের সিনেমা বানিয়েছেন তিনি। রবীন বলছেন, ‘‘এক সময়ে বাবার পরিচয় না থাকায় স্কুলে ভর্তি হতে অসুবিধায় পড়ত যৌনকর্মীর সন্তানেরা। বাইরের সমাজেনিজের পরিচয় দিতে ভয় পেত। আজও খেলার মাঠে তাদের বৈষম্যের শিকার হতে হয়। তাই নিজের পাড়া, নিজের এলাকার গল্পকেইএখানে তুলে ধরেছি। যৌনপল্লিতে শিশুদের উপরে একটা মনস্তাত্ত্বিক প্রভাব পড়ে, সেটাও দেখাতে চেয়েছি। কুশীলবেরা কেউই সেই অর্থে পেশাদার অভিনেতা নন। তাই তাঁদের স্বতঃস্ফূর্ততাই এই সিনেমার মূল আকর্ষণ।’’

তবে অল্পবিস্তর থিয়েটারে অভিনয়ের অভিজ্ঞতা ছিল বলেই ক্যামেরার সামনে সাবলীলচরিত্রায়ন করেছেন তাপসী অধিকারী ও পূজা রায়। তাঁরা বলছেন, ‘‘এটা নিছক সিনেমা নয়। এটা আমাদের প্রতিদিনের জীবনেরই প্রতিচ্ছবি। কী ভাবে এই এলাকায় বড় হয়েছি, প্রতিনিয়ত কতটা যুদ্ধ করতে হয়েছে, তা-ই দেখানো হয়েছে। কোনও ওয়ার্কশপ, সংলাপ মুখস্থ করার প্রয়োজন পড়েনি।’’

আর দুই খুদে অভিনেতা? কালীঘাটের যৌনপল্লির বাসিন্দা, অষ্টম শ্রেণির ও চতুর্থ শ্রেণির ওই দুই পড়ুয়া আপাতত অভিনয়েরআনন্দে বুঁদ। তারা তাই বলছে,‘‘প্রথমে ক্যামেরার সামনে ভয় লাগছিল, পরে ভাল লাগতে শুরু করেছে। বড় হয়ে অভিনেতাইহতে চাই।’’

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন

এটি একটি প্রিমিয়াম খবর…

  • প্রতিদিন ২০০’রও বেশি এমন প্রিমিয়াম খবর

  • সঙ্গে আনন্দবাজার পত্রিকার ই -পেপার পড়ার সুযোগ

  • সময়মতো পড়ুন, ‘সেভ আর্টিকল-এ ক্লিক করে

সাবস্ক্রাইব করুন