যতই সে অপরাধে অভিযুক্ত হোক, যতই তাকে গ্রেফতার করতে অভিযান চলুক, গ্রেফতারের ইঙ্গিত দিক নবান্নের শীর্ষমহল, এক শ্রেণির পুলিশ অফিসার তাতে বাগড়া দিয়েই যাবেন। গিরিশ পার্ক কাণ্ডে প্রধান অভিযুক্ত গোপাল তিওয়ারিকে ধরতে নেমে এই উপলব্ধিই হচ্ছে গোয়েন্দা অফিসারদের একাংশের। তাঁদের বক্তব্য, কত কমিশনার, গোয়েন্দাপ্রধান লালবাজারে এলেন-গেলেন, কিন্তু গোপাল তিওয়ারিদের গেরো থেকে কলকাতা পুলিশ বেরোতে পারল না। গিরিশ পার্কে সাব-ইনস্পেক্টর জগন্নাথ মণ্ডল গুলিবিদ্ধ হওয়ার পরে এক সপ্তাহ পরেও গোপাল অধরাই।
এক অফিসার জানান, কুখ্যাত তোলাবাজ শেখ দীনেশের গতিবিধি জানিয়ে পুলিশকে সাহায্য করেছিল গোপাল। সোর্স হিসেবে ধরিয়ে দিয়েছিল রিষড়ার ভীমনাথ সিংহ ও হাওড়ার মনোজ সিংহকে। ওই অফিসার বলেন, ‘‘গোপাল জানে, কী ভাবে পুলিশের চোখে ধুলো দিতে হয়। আমাদেরই কয়েক জনের সঙ্গে ওর রীতিমতো ওঠাবসা।’’
গোপালকে যে ভাবে আড়াল করার চেষ্টা হচ্ছে তা নিয়ে বিরক্ত শীর্ষকর্তারাই। তাঁদের বক্তব্য, ‘‘সোর্স হলেও গোপাল অপরাধে অভিযুক্ত। তাকে রেহাই দেওয়া যায় না। তা যখন হচ্ছে, তখন কীসের স্বার্থ তা তো বুঝতেই পারছি।’’
পুলিশ জানায়, গোপালকে বাঁচাতে ওই অফিসারেরা তৎপর হয়েছেন ‘বিশেষ’ কারণে। ২০০৫-এ পোস্তায় এক চায়ের দোকানদারকে উচ্ছেদের লক্ষ্যে গুলি চালিয়ে জখম করার ঘটনায় গোপালকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেয় সিটি সেশনস কোর্ট। ২০১১ সালে জামিনে মুক্তি পায় গোপাল। কিন্তু গিরিশ পার্ক কাণ্ডে গোপাল ধরা পড়লে এখন পোস্তার ওই মামলার তদন্তকারীরা তার জামিন বাতিলের আবেদন করবেন। আদালত তা মানলে গোপালের ফের কারাবাস নিশ্চিত বলে আশা গোয়েন্দাদের। সেটাই ঠেকাতে চেষ্টা করছেন গোপাল-ঘনিষ্ঠ অফিসারেরা।
লালবাজার সূত্রে খবর, গত বছর উত্তর কলকাতার এক হোটেলে গোপালের সঙ্গীরা গোলমাল বাধালে তাকে লালবাজারে তলব করা হয়। তখনও একাধিক অফিসার গোপাল ও তার দলকে নির্দোষ প্রতিপন্ন করতে তৎপর হন।
গিরিশ পার্ক কাণ্ডের পিছনে যে গোপাল আছে, তা নিয়ে গোয়েন্দারা নির্দিষ্ট তথ্য পাওয়ার পরেও পুলিশেরই কিছু অফিসার বিষয়টিকে উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ভাবে গুলিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেন বলে লালবাজার সূত্রে খবর। এক শ্রেণির অফিসার এটাও বলার চেষ্টা করেন, সিংহীবাগানে যে বাইক বাহিনী ১৮ তারিখ বোমা-গুলি ছোড়ে, তারা গোপালের চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী মনোজ সিংহের লোক। আবার, কারণে-অকারণে যে কোনও নাগরিকের মোবাইলে আড়ি পাতায় সিদ্ধহস্ত বলে পরিচিত এক ইনস্পেক্টর বোঝানোর চেষ্টা করেন, গিরিশ পার্কের ঘটনায় গোপাল আদৌ জড়িত কি না, তা নিয়ে ধোঁয়াশা আছে।
কিন্তু ততক্ষণে দুই ধৃত জানিয়ে দিয়েছে, ‘ভাইয়া’ মানে গোপালের কথা মতোই তারা বাইকে চড়ে বন্দুক, বোমা নিয়ে বেরিয়েছিল। ফলে, গোয়েন্দাপ্রধান পল্লবকান্তি ঘোষ-সহ শীর্ষকর্তাদের টলানো যায়নি।
দশ বছর আগে পোস্তার ঘটনায় গোপালকে ধরতে গুন্ডাদমন শাখার একটি দল গোপনে হায়দরাবাদ যায়। পাছে সে খবর গোপাল লালবাজার থেকে পেয়ে যায়, তাই খাতায়-কলমে দেখানো হয় ওই অফিসারেরা অসুস্থতার জন্য ছুটিতে। গুন্ডাদমন শাখায় গোপালের ‘নেটওয়ার্ক’ ছিল এতটাই। তৎকালীন সিপি প্রসূন মুখোপাধ্যায় বলেছিলেন, ‘‘গোপালকে ধরতে এমন গোপনীয়তাই বাঞ্ছনীয়!’’ গোপাল-ঘনিষ্ঠ কিছু অফিসারের জন্য পুলিশেরই অনেকে তখন গুন্ডাদমন শাখাকে ‘গুন্ডা পালন শাখা’ বলতেন।
লালবাজারের এক শীর্ষকর্তার দাবি, ‘‘গুন্ডাদমন শাখাকে এখন সে বদনাম দেওয়া যাবে না।’’ সঙ্গে তাঁর স্বীকারোক্তি, ‘‘বাহিনীতে এখনও কিছু অফিসার বিশেষ স্বার্থে গোপালের মতো দুষ্কৃতীকে আড়াল করার নির্লজ্জ চেষ্টা চালাচ্ছেন।’’
কিন্তু গোপালকে ‘বিশেষ কারণে’ আড়াল করছেন বলে জানার পরেও সেই অফিসারদের বিরুদ্ধে দশ বছর আগেও ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। সেই ট্র্যাডিশন অব্যাহত। অর্থাৎ গোপাল তিওয়ারি লালবাজারের গেরো হয়েই থাকছে।