বাগবাজার

বদলেছে অনেক কিছু,তবু ঐতিহ্য অটুট

আমাদের বাগবাজার এলাকাটাই ঐতিহ্যময়। বহু বিখ্যাত মানুষকে দেখেছে এই সাবেক পাড়া। আমার বাড়ি থেকে দু’পা এগোলেই বলরাম বসুর বাড়ি। এখন নাম হয়েছে ‘বলরাম মন্দির’। এখানেই রামকৃষ্ণ মিশন প্রতিষ্ঠার সিদ্ধান্ত হয়েছিল। শ্রীরামকৃষ্ণ নিজেও এখানে বহু বার এসেছেন। কাছেই থাকতেন গিরিশ ঘোষ। শ্রীমায়ের বাড়িও এই এলাকায়। পিছনে বোস পাড়া লেন-এ সিস্টার নিবেদিতার বাড়ি ছিল।

Advertisement

শ্যামলকুমার সেন

শেষ আপডেট: ০৬ জুন ২০১৫ ০০:২৭
Share:

আমাদের বাগবাজার এলাকাটাই ঐতিহ্যময়। বহু বিখ্যাত মানুষকে দেখেছে এই সাবেক পাড়া।

Advertisement

আমার বাড়ি থেকে দু’পা এগোলেই বলরাম বসুর বাড়ি। এখন নাম হয়েছে ‘বলরাম মন্দির’। এখানেই রামকৃষ্ণ মিশন প্রতিষ্ঠার সিদ্ধান্ত হয়েছিল। শ্রীরামকৃষ্ণ নিজেও এখানে বহু বার এসেছেন। কাছেই থাকতেন গিরিশ ঘোষ। শ্রীমায়ের বাড়িও এই এলাকায়। পিছনে বোস পাড়া লেন-এ সিস্টার নিবেদিতার বাড়ি ছিল।

এত কথা বলার একটাই কারণ। এই পাড়া কতটা পুরনো, তা বোঝাতে চাইছি। আমি নিজে যে বাড়িতে বড় হয়েছি, সেটির বয়সও এখন ১৬০ বছর। চার দিকে যখন জীবনযাত্রা একেবারেই বদলে গিয়েছে, পুরনো দিনের বাঙালিয়ানা এখনও কিছুটা হলেও ধরে রেখেছে আমাদের পাড়া। কিছু বদলায়নি এমন ভাবার কারণ নেই। বদল তো আসবেই। তবু ঐতিহ্য ধরে রেখেছে এখানকার অলিগলি।

Advertisement

উত্তর কলকাতার রকের আড্ডা খুব বিখ্যাত সব সময়েই। সে সব কিন্তু এখন এ পাড়াতেও খুব একটা নেই। অধিকাংশ বাড়ির চেহারাই বদলে গিয়েছে। আগে সব বাড়ির সঙ্গে থাকত উঠোন আর বসার রক। উঠোনে ছোটরা খেলত, আর বড়রা রকে গল্প করতেন। একে-অপরের সঙ্গে মেলামেশা ছিল বাগবাজার অঞ্চলের বৈশিষ্ট। আমাদের ছোটবেলায় বিকেলটা ছিলই হইচইয়ের। বড়রাই বলে দিতেন, ‘যাও খেলার সময় হয়েছে।’

এখন এখানের অধিকাংশ বাড়িরই রূপ বদলেছে। সামনের গিরিশ অ্যাভিনিউ ধরে হাঁটার সময়ে কোনও বাড়ির সঙ্গেই উঠোন চোখে পড়ে না। পাড়ায় খেলাধুলোর হইচইও আগের তুলনায় অনেক কম চোখে পড়ে। এখন ছোট-বড় সকলেই ব্যস্ততায় মগ্ন।

তবে এই পরিবর্তনকে খারাপ বলতে চাই না। বদল তো মানতেই হবে। ভবানীপুরের পাড়াগুলোর রীতি-রেওয়াজও তো এক সময়ে এখানকার মতোই ছিল। এখন ওই সব এলাকায় ঢুকলে চেনাই যাবে না। সাবেক মেজাজটাই হারিয়ে গিয়েছে। কলকাতার লোকেদের সংখ্যাই কমে গিয়েছে। বড় বড় বাড়িগুলোও এখন আর বাঙালিদের হাতে নেই। বহু জায়গায় পুরনো বাড়ি ভেঙে প্রোমোটিং হয়েছে। আমাদের পাড়ায় কিন্তু সে সব অনেক কম। পুরনো বাড়ি ভেঙে নতুন কায়দায় তৈরি হয়েছে বড়জোর। প্রোমোটিং অত বেশি হয়নি।

এক সময়ে বাকি উত্তর কলকাতার মতো এখানেও পাড়ার ক্লাবের রমরমা ছিল। আমাদের পাশের বাড়িতেই একটা ঘরে বসত ‘নিউ বয়েজ ক্লাব’-এর আড্ডা। পাড়ার ছেলেরা মিলে সেই ক্লাবের তরফে সরস্বতী পুজোও করেছি। বাড়ি বাড়ি গিয়ে চাঁদা তুলতে বেরোনোও তখন ছিল আনন্দের। নিজেদের বাড়িতে যতই পুজো হোক, ক্লাবের পুজোর আড্ডাটাই আলাদা। সেই ক্লাব অবশ্য বহু দিন আগেই ইতিহাস হয়ে গিয়েছে।

‘সেন বাড়ি’, মানে আমাদের বাড়িটাও, কার্যত একটা ক্লাবই ছিল। দু’টো ঘর দিনভর সরগরম থাকত পাড়ার লোকেদের আড্ডায়। একটা ঘরে ক্যারম, তাস খেলা চলত। পাশের ঘরে বসত ‘হইহই ক্লাব’-এর আড্ডা। আমাদের পুরনো বাড়ির একটা ঘরে আজকাল মাঝেমধ্যে অনেকে মিলে তাস খেলা হয়, তবে সেই সামাজিকতা আর নেই। তবু এটুকু বলতেই হবে, একসঙ্গে হইচই করা কমলেও, কারও কিছু সমস্যা হলে পাশে এসে দাঁড়ানোর রেওয়াজটা এখনও যায়নি। এইটুকুই বা এখন ক’টা পাড়ায় আছে?

এক সময়ে ফুটবলও ছিল এই পাড়ার রোজ-নামচার সঙ্গে জড়িয়ে। এখানকার শ্যাম পার্কে কত বড় বড় মানুষ খেলেছেন। ক্রিকেটার পঙ্কজ রায় অনেক বার এখানে ফুটবল টুর্নামেন্টে খেলেছেন। মোহনবাগান ক্লাবের তৃতীয় ফুটবল মাঠ এই
শ্যাম পার্ক। আমার ঠাকুরদা মণিলাল সেন ছিলেন মোহনবাগানের প্রথম ফুটবল ক্যাপটেন।

এখন শ্যাম পার্ক ছোট হয়ে গিয়েছে। কিছুটা অংশ নিয়ে তৈরি হয়েছে শিশুদের পার্ক। এখন আর পাড়ার সকলে মিলে খেলাধুলো, ফুটবল ম্যাচ এখানে দেখা যায় না। তবে আমি রোজই শ্যাম পার্কে হাঁটতে যাই। কুশল বিনিময়ের চলটুকু এখনও আছে এখানে। রাস্তায় বেরোলে পড়শিদের খবর জানা যায়।

আয়তনে ছোট হওয়া এখনকার শ্যাম পার্কে একটি ছেলে বাচ্চাদের ফুটবল প্রশিক্ষণ দেয়। খেলতে আসা বাচ্চারা কেউই বোধহয় এই পাড়ার নয়। অনেকেই দুঃস্থ পরিবারের। কষ্ট করেই চলে সেটি। তবু বাঙালির ফুটবল সংস্কৃতিটা তো ধরে রেখেছে শ্যাম পার্ক। মাঝে স্থানীয় কাউন্সিলর পার্থ মিত্র ওদের খেলা শেখার জন্য সরকারি টাকার ব্যবস্থা করে দেন। ম্যাচও হয় কখনও-সখনও।

বাঙালিয়ানা ধরা আছে বারোয়ারি দুর্গোৎসব, জগদ্ধাত্রী পুজোতেও। পাড়ার অনেকেই উৎসাহ দেন এই পুজোয়। বছরভর নিরিবিলি, শান্ত এই পাড়া হঠাৎ চনমনে হয়ে ওঠে ওই সময়ে। তবে জগদ্ধাত্রী পুজোর সময়ে ভিড়টা একটু বেশিই হয়। তখন পাড়ার মধ্যে দিয়ে চলাফেরা করা মুশকিল হয়ে ওঠে। এই পাড়ার শান্তিভঙ্গ হয় শুধু মাঝেমধ্যে মণীন্দ্র কলেজের ছাত্ররাজনীতির জেরে গোলমালে।

কাজের সূত্রে বহু জায়গায় ঘুরেছি। এক-এক জায়গার এক-এক রীতি-রেওয়াজ ভাল লেগেছে। ভাবতে গেলে, গোটা বিশ্বকেই নিজের পাড়া বলে মনে করি। কিন্তু শিকড়ের টান অন্য। কত লোকে কর্মক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠিত হয়ে পুরনো পাড়া ছেড়েছেন। আমার কখনও মনেই হয়নি অন্য কোথাও গিয়ে থাকার কথা। ভাল-মন্দ সব মিলিয়ে এ পাড়া এখনও আমার বাড়ি।

লেখক প্রাক্তন বিচারপতি।

ছবি: দেবস্মিতা ভট্টাচার্য।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন