Kolkata

এ শহরের হৃৎপিণ্ড মুঠোবন্দি করে দৌড়ে বেড়ান সেলিমেরা

হাতের তালু উপুড় করলেন সেলিম। অন্য হাতে তখন বিস্কুটের প্যাকেট। এস এন ব্যানার্জি রোডে যখন সেলিমকে পাওয়া গেল, তখন তিনি বিস্কুট বার করে খাচ্ছিলেন।

Advertisement

দেবাশিস ঘড়াই

শেষ আপডেট: ২০ মার্চ ২০২১ ০৭:১৭
Share:

রিকশা নিয়ে যাত্রীর অপেক্ষায় সেলিম। নিজস্ব চিত্র

হাতের তালু উপুড় করলেন সেলিম। অন্য হাতে তখন বিস্কুটের প্যাকেট। এস এন ব্যানার্জি রোডে যখন সেলিমকে পাওয়া গেল, তখন তিনি বিস্কুট বার করে খাচ্ছিলেন। প্রথমে থতমত খেয়ে গিয়েছিলেন। ইদানীং প্রশ্নে বড় ভয় সেলিমের। তার পরে ভয়, জড়তা কাটতে হাতের তালু উপুড় করে দিয়েছিলেন। —‘‘দেখুন, টানতে টানতে হাতে কালো দাগ পড়ে গিয়েছে। যখন গোঁফ বেরোয়নি, তখন থেকে রিকশা টানছি।’’

Advertisement

হাতের তালুর কালো দাগ দেখাচ্ছেন সেলিম। যার উপরে ছায়া ফেলেছে এ শহরের আকাশ। সেলিম বলে চলেছেন, ‘‘খিদিরপুর, রাজাবাজার, হাওড়া পর্যন্ত যাত্রীদের নিয়ে গিয়েছি।’’ এত দূর দূর গিয়েছেন! ‘‘হ্যাঁ, এত দূরে গিয়েছি।’’— সগর্বে উত্তর দিলেন সেলিম। তাই হয়তো সেলিমের হাতের রেখায় কলকাতার জনপথ, অলিগলি মিলেমিশে গিয়েছে।

‘‘কিন্তু লকডাউনের সময়ে খুব কষ্টে ছিলাম। বাড়ি যেতে পারিনি। রিকশার পাশে রাস্তাতেই শুয়ে থাকতাম। পুলিশ তাড়িয়ে দিলে অন্য জায়গায় চলে যেতাম।’’, বলে চলেছেন সেলিম। অথচ ক্যানিং লাইনের ঘুঁটিয়ারি শরিফে সেলিমের ভাড়ার বাড়ি। সেই বাড়িতে বৌ আর মেয়ে রয়েছেন। সেলিম বলেন, ‘‘পুরো লকডাউনে এ ভাবে থেকেছি। কারণ, বাড়ি যেতে কোনও গাড়ি যে টাকা চাইছিল, তাতে কয়েক কেজি চাল, ডাল হয়ে যেত।’’ কী খেয়ে থাকতেন? মেয়ে আর বৌ-ই বা কী খেতেন? বিস্কুটের প্যাকেট থেকে একটি বিস্কুট বার করে মুখে দিতে দিতে উত্তর দিলেন, ‘‘যখন যেখানে খিচুড়ি দেওয়া হত, তাই খেয়েছি। সংসার চালাতে বৌ টাকা ধার করেছিল। সে টাকা এখনও মেটাচ্ছি।’’ এর মধ্যেই সেলিম জানালেন, রিকশাটা তাঁর নিজের নয়। ভাড়ায় নেওয়া। প্রতিদিন পঞ্চাশ টাকা করে রিকশার মালিককে ভাড়া দিতে হয়।

Advertisement

অবশ্য শহরের ইতিহাস বলছে, শুধু এখন বলেই নয়। বরাবরই চালককে রিকশার মালিককে ভাড়া দিতে হত। অতীতে দৈনিক ভাড়া ছিল ১ টাকা ৬০ পয়সা। কোনও কোনও রিকশার ক্ষেত্রে আবার ২ টাকা। কলকাতা গবেষকদের একাংশ জানাচ্ছেন, হাতে টানা রিকশা চালাতে এক সময়ে চালকদের কলকাতা পুরসভার ট্রেড লাইসেন্স দফতর থেকে লাইসেন্স নিতে হত। প্রতি মালিকের কাছ থেকে পুরসভার বছরে ১৫ টাকা আয় হত।

কলকাতা-গবেষক হরিপদ ভৌমিক জানাচ্ছেন, হাতে টানা রিকশার জন্ম জাপানে। লেডি ডাফরিনের স্মৃতিকথা থেকে জানা যায়, ১৮৮০ সাল নাগাদ এই গাড়ি ভারতের শিমলায় পৌঁছয়। তাঁর কথায়, ‘‘১৯০০ সাল নাগাদ কলকাতাবাসী কয়েক
জন চিনা নিজেদের যাতায়াতের জন্য এই রিকশার আমদানি করেছিলেন শহরে। ১৯২০ সালের মধ্যে রিকশার ব্যবসা পুরোপুরি ভারতীয়দের হাতে এসে যায়।’’

কলকাতা পুলিশের একটি সূত্র বলছে, ১৯৪৯ সালে আইন পাশ করে ছ’হাজারের বেশি হাতে টানা রিকশাকে লাইসেন্স দেওয়া হবে না বলে জানানো হয়েছিল। পরে অবশ্য হাতে টানা রিকশা তুলে দিতে উদ্যোগী হয়েছিল তৎকালীন রাজ্য সরকার। এক কলকাতা গবেষকের কথায়, ‘‘১৯৭৩ সালের জুন মাসে পুলিশ কমিশনার বিজ্ঞপ্তি জারি করে জানিয়েছিলেন, রবিবার এবং অন্যান্য ছুটির দিন ছাড়া সপ্তাহের কাজের দিনগুলিতে...সকাল ৮টা থেকে রাত ৮টার মধ্যে হাতে টানা রিকশা চালানো বা দাঁড় করিয়ে রাখা যাবে না।’’ যা নিয়ে রিকশাচালকেরা ধর্মঘট করেন। পুলিশের সঙ্গে তাঁদের সংঘর্ষও হয়। সেই সময়ে সংবাদপত্রের সম্পাদকীয়তে লেখা হয়েছিল,—‘শতাধিক বছর পরেও শহর কলিকাতায় একই দৃশ্য, একই ধরণের মনুষ্যবাহী যান, ঘটনাটি চমকপ্রদ বই কী! কলিকাতা যে কলিকাতাতেই আছে, অতঃপর তাহাতে বোধ হয় সংশয়ের বিন্দুমাত্র অবকাশ রহিল না।’

যার পরিবর্তন হয়নি এখনও। এর পরিপ্রেক্ষিতে মানবাধিকার কর্মী সুজাত ভদ্র জানাচ্ছেন, এক জন বৃদ্ধ মানুষ রিকশায় আরামে বসে থাকা দু’জনকে হাতে টেনে নিয়ে যাচ্ছেন, এ তো মানবতার অপমান! তাঁর কথায়, ‘‘যে কোনও পেশাতেই মানবিকতা, সম্মান থাকাটা জরুরি। হাতে টানা রিকশাকে যন্ত্রচালিত রিকশা করে দেওয়া হোক। সেই দায় তো সরকারকে নিতে হবে।’’

কিন্তু সেলিমদের দায়িত্ব আর কে নেয়? তাই হাতে টানা রিকশা চালানো বেআইনি জেনেও সেলিম বলছেন, ‘‘এ ছাড়া আর কী করব? আমাদের তো ভবিষ্যৎ নেই।’’ কবি ভাস্কর চক্রবর্তী লিখেছিলেন, ‘আমাদের স্বর্গ নেই, স্যারিডন আছে’। সেলিমদের জন্য হয়তো লেখা যায়, ‘ওঁদের ভবিষ্যৎ নেই। কিন্তু হাতের তালুতে এ শহরের হৃৎপিণ্ড আছে।’ যে হৃৎপিণ্ড মুঠোবন্দি করে রোজ এ শহরের রাজপথ, অলিগলি হন্যে হয়ে দৌড়ে বেড়ান সেলিমেরা।—শুধুমাত্র অন্নের সন্ধানে!

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement
Advertisement