রাজ্যের বাহিনী নিধিরাম, উদ্ধার কাজে তফাত গড়ল সেনারাই

রাজ্য সরকার ঘটা করে বিপর্যয় মোকাবিলা দফতর খুলেছে। তার আলাদা মন্ত্রী, আলাদা বাহিনী। কিন্তু বৃহস্পতিবার বারবেলায় বড়বাজারের মাথায় যখন সত্যিই বিপর্যয় নেমে এল, বিভ্রান্ত, অসহায় সেই বাহিনী। কী ভাবে চাঙড় সরাবেন, কী ভাবে শুরু করবেন উদ্ধার কাজ— কেউই যেন বুঝে উঠতে পারছেন না।

Advertisement

নিজস্ব সংবাদদাতা

শেষ আপডেট: ০২ এপ্রিল ২০১৬ ০৩:৫৮
Share:

ঘটনাস্থল পরিদর্শনে ব্যস্ত বিশেষজ্ঞরা। ছবি: স্বাতী চক্রবর্তী।

রাজ্য সরকার ঘটা করে বিপর্যয় মোকাবিলা দফতর খুলেছে। তার আলাদা মন্ত্রী, আলাদা বাহিনী। কিন্তু বৃহস্পতিবার বারবেলায় বড়বাজারের মাথায় যখন সত্যিই বিপর্যয় নেমে এল, বিভ্রান্ত, অসহায় সেই বাহিনী। কী ভাবে চাঙড় সরাবেন, কী ভাবে শুরু করবেন উদ্ধার কাজ— কেউই যেন বুঝে উঠতে পারছেন না। শুধু দিশাহীন দৌড়োদৌড়ি করে চললেন তাঁরা। একই অবস্থা পুলিশেরও।

Advertisement

কাছেই পোস্তা থেকে তত ক্ষণে দৌড়ে এসেছে সিআরপি-র অফিসার ও জওয়ানদের একটি দল। রাজ্য সরকারের বিপর্যয় মোকাবিলা বাহিনী যে দু’টো ক্রেন নিয়ে এসে ভেঙে পড়া সেতুর বিম সরানোর চেষ্টা করছিল, তাদের সে ক্ষমতাই ছিল না। উদ্ধার করা যাচ্ছিল না বিমের তলায় চাপা পড়া মানুষগুলোকে।

পাশে তখন উপুড় হয়ে পড়ে রয়েছে ফুট ৪০ লম্বা, ১৫ ফুট চওড়া সিমেন্টের একটি চাঙড়। বাতাসে ভারী গুজবে— ওই চাঙড়ের তলাতেই চাপা পড়ে রয়েছে বাস, তাতে রয়েছে স্কুল পড়ুয়ারা। কলকাতা পুলিশের কর্তারা তখন শুধু মাথা চুলকোচ্ছেন আর পাক খাচ্ছেন ওই চাঙড় ঘিরে। কোথা থেকে শুরু করবেন সেটাই ঠিক করে উঠতে পারছেন না রাজ্যের বিপর্যয় মোকাবিলা বাহিনী। এই ধরনের বিপর্যয় হলে, চটজলদি উদ্ধারের জন্য যে ধরনের যন্ত্রপাতি দরকার তা যে রাজ্যের এই নাম-কা-ওয়াস্তে দফতরের নেই— তা পরিষ্কার হয়ে গিয়েছে বৃহস্পতিবার। দফতরের এক কর্তার কথায়, ‘‘এখানে বিপর্যয় মোকাবিলায় ত্রিপল, চাদর, দড়ি— এই সবই মূলত ব্যবহার করা হয়। যন্ত্রপাতি আর কী থাকবে!’’

Advertisement

দুর্ঘটনার খবর পেয়ে সেনাবাহিনী প্রথমেই ২৪০ জন জওয়ান ও অফিসারের সঙ্গে নিয়ে গিয়েছে ড্রিলিং মেশিন, ৩টি মেডিক্যাল টিম, ২টি অ্যাম্বুল্যান্স, ২ জন সার্জেন এবং একটি ইঞ্জিনিয়ারদের দল। পরের দু’ঘণ্টায় যোগ হয়েছে আরও ৮টি অ্যাম্বুল্যান্স, ৪টি ক্রেন এবং গ্যাস কাটারদের দু’টি দল। সেনাবাহিনীর সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে কাজ করতে দেখা গিয়েছে জাতীয় বিপর্যয় মোকাবিলা দল (এনডিআরএফ)-কেও। সেনাবাহিনীর সঙ্গে যাঁরা এলেন, তাঁরা সকলেই চূড়ান্ত পেশাদার এবং প্রশিক্ষিত। স্থানীয় প্রত্যক্ষদর্শীদেরও চোখে লেগেছে দুই বাহিনীর তফাতটা। কারণ পুলিশ ও বিপর্যয় মোকাবিলা কর্মীদের হাঁটাচলায়, হাবে-ভাবে সেটারই অভাব স্পষ্ট। কলকাতা পুলিশের অফিসার ও কর্মীদের যে উদ্ধাররের কাজে প্রশিক্ষণ নেই, পেশাদারিত্ব নেই— তা যেন প্রতিটি মূহূর্তে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছিল। এত বড় দুর্ঘটনাস্থলে অগ্রাধিকার দিয়ে কোন কাজটা আগে করতে হয়, তার কোনও পরিকল্পনাই ছিল না। ক্রেনকে পথ দেখিয়ে নিয়ে আসা, হাতে করে স্ট্রেচার নিয়ে আসা, ভিড় সামলানো— মূলত এই ছিল তাঁদের কাজ।

সেনাবাহিনী কাজে নামতে ছবিটাই গেল বদলে। পাশ থেকে স্থানীয় বাসিন্দা গোপাল বেরিয়াল বললেন, ‘‘দেখুন, এদের শরীরের ভাষাটাই আলাদা।’’ বৃহস্পতিবার দুপুর থেকে ঘটনাস্থলে থাকা এক সেনা অফিসার শুক্রবার ব্যক্তিগত আলাপচারিতায় বলেন, ‘‘ওই চাঙড়টা তখনই ভেঙে সরানো সম্ভব ছিল না। কারণ হতেই পারত, তার নীচে জীবিত কেউ চাপা পড়ে রয়েছেন। চাঙড় ভাঙতে গেলে তিনিও মারা যেতে পারেন।’’ ওই সেনা অফিসারের কথায়— ‘‘মনে রাখবেন, আমরা সেখানে গিয়েছিলাম জীবিত়দের উদ্ধারে।’’ এই ভাবনা থেকেই শুরু হয় ‘অপারেশন’। পুলিশ তখন দূরে দর্শক। ঠিক হয়, আগে সিমেন্টের চাঙড়ে ছোট্ট একটা গর্ত করা হবে। সেই গর্ত দিয়ে কোনও সেনা সদস্য নীচে নেমে দেখবেন জীবিত কেউ রয়েছেন কি না। দুপুর তিনটে থেকে তা শুরু হয়। বিকেল ৫টা ২১ মিনিটে চাঙড়ে গর্ত করে প্রথম এক জওয়ান নামেন। সঙ্গে যান এনডিআরএফ-এর এক কর্মীও। তাঁরাই জানান, চাঙড়ের তলায় জীবিত কেউ নেই। তার পরই ক্রেন দিয়ে চাঙড় সরানোর কাজ শুরু করা হয়।

পুলিশ কেন দিশাহীন? সেনারা যে সিদ্ধান্ত নিল, পুলিশ কেন তা নিতে পারল না? সেনাবাহিনীর এক অফিসার বলেন, ‘‘কাউকে দোষারোপ করা উচিত নয়। ওরা কিছু কাজে দক্ষ। আমরা কিছু কাজে। পুলিশ যেমন আইন-শৃঙ্খলা সামলাতে পারে, আমরা হয়তো তা পারব না।’’ ঘিঞ্জি বাজারে পুলিশ রাস্তা পরিষ্কার করে না-দিলে সেনাবাহিনীর পক্ষে সেখানে পৌঁছনো সম্ভব হতো না বলে কৃতজ্ঞতাও প্রকাশ করেন তিনি। সেনা সদস্যরা বিতর্কে যেতে না-চাইলেও স্থানীয় বাসিন্দারা বলতে ছাড়ছেন না। এক জনের কথায়, ‘‘সেনা অফিসাররা যখন উদ্ধারে ব্যস্ত, পুলিশ ব্যস্ত মুখ্যমন্ত্রীকে নিয়ে। আরও নেতা-আমলারা এসেছেন। উদ্ধারকাজ ফেলে তখন তাঁদেরই সামলাচ্ছে পুলিশ।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন