মোমবাতি আর জ্বলে না স্টিফেন কোর্টে

ভরদুপুরে দাউ দাউ করে জ্বলে উঠেছিল ‘জতুগৃহ’ স্টিফেন কোর্ট। শহর কলকাতার অন্যতম অভিজাত এলাকা পার্ক স্ট্রিটের বুকে পুড়ে আর প্রাণ বাঁচাতে ঝাঁপিয়ে মারা গিয়েছিলেন ৪৩ জন। ২৩ মার্চ, ২০১০।

Advertisement

সুনন্দ ঘোষ

শেষ আপডেট: ২৪ মার্চ ২০১৮ ০২:২১
Share:

দেখতে দেখতে আট বছর পার!

Advertisement

ভরদুপুরে দাউ দাউ করে জ্বলে উঠেছিল ‘জতুগৃহ’ স্টিফেন কোর্ট। শহর কলকাতার অন্যতম অভিজাত এলাকা পার্ক স্ট্রিটের বুকে পুড়ে আর প্রাণ বাঁচাতে ঝাঁপিয়ে মারা গিয়েছিলেন ৪৩ জন। ২৩ মার্চ, ২০১০।

তার পর থেকে প্রতি বছর এই দিনটিতে পার্ক স্ট্রিটের ওই বাড়িটির গেটের সামনে সকালে-দুপুরে গুটি গুটি পায়ে জড়ো হতে দেখা যেত কয়েক জন শোকস্তব্ধ মানুষকে। হাতে মোমবাতি, প্রিয়জনের ছবি। মৃত বাবা, মা, সন্তান, স্বামী বা স্ত্রীকে নিজের মতো করে শ্রদ্ধা জানাতে কয়েক মুহূর্ত একসঙ্গে থেকে, এক সন্তানহারা পিতা অন্য সন্তানহারা বাবার হাত খানিক ক্ষণ চেপে ধরে আবার ফিরে যেতেন যে যাঁর বাড়ি।

Advertisement

সেই যোগাযোগটাও গত দু’তিন বছর ধরে বন্ধ। স্টিফেন কোর্টের সেই গেটের সামনে আর ২৩ মার্চ মোমবাতি জ্বলে না। স্বামী সত্যজিৎ সেনগুপ্তকে হারানো সাধনাদেবীর ছেলে গত আট বছরে অনেকটাই স্বাবলম্বী হয়ে উঠেছে। সাধনাদেবী নিজেও চাকরি করছেন। ‘‘এখন তো আর কেউ আসে না। আমি একা একা গিয়ে কী করব?’’ — শুক্রবার ফোনে জানালেন সাধনাদেবী।

মেয়ে মৌমিতাকে হারানো জয়চন্দ্র ঘোষ বলেন, ‘‘প্রথম ক’টা বছর গিয়েছিলাম। কিন্তু আর যাই না। কী হবে গিয়ে? ফেরত পাব মেয়েকে?’’ মৃতদের সবাই ছিলেন বেসরকারি সংস্থার কর্মী। যতটা ক্ষতিপূরণ পাওয়া উচিত ছিল, ততটা পাওয়া যায়নি — আত্মীয়দের সবার মধ্যে এই ক্ষোভ কমবেশি আজও ধিকিধিকি জ্বলে। জয়চন্দ্রবাবু ও তাঁর সঙ্গে আরও জনা দুয়েক মানুষ সেই সংস্থার বিরুদ্ধে মামলা করেছিলেন। কিন্তু ক্ষতিপূরণ পাওয়ার সেই মামলা বছর দুয়েক চালিয়ে হতাশ হয়ে পড়েন জয়চন্দ্রবাবু।

আগুনের গ্রাসে স্টিফেন কোর্ট। —ফাইল চিত্র।

এই শোকাকুল পরিবারগুলির মধ্যে ব্যতিক্রমী শুধু শৈলেন বারিক। এখনও মামলা লড়ে যাচ্ছেন। উকিলের সঙ্গে ঝগড়া করছেন। আট বছর আগে, খবর পেয়ে স্ত্রীকে নিয়ে স্টিফেন কোর্টের সামনে ছুটে এসে চিৎকার করে উঠেছিলেন, ‘‘ছেলে কই আমার!’’ সেই ছেলে, ২২ বছরের সৌরভ প্রাণ বাঁচাতে ঝাঁপ দিয়েছিলেন জানলা গলে। কাছেরই একটি হাসপাতালের ঠান্ডা ঘরে শোয়ানো ছিল তাঁর নিথর দেহ। একমাত্র সন্তানকে হারিয়ে শোকে পাথর হয়ে গিয়েছিলেন টিটাগড়ের শৈলেনবাবু ও তাঁর স্ত্রী।

কেন্দ্রীয় সরকারি চাকরি করেন শৈলেনবাবু। অসুস্থ হয়ে পড়া স্ত্রীকে বাঁচাতেই কল্লোলকে নিয়ে এসেছিলেন হোম থেকে। সেই কল্লোল এখন ষষ্ঠ শ্রেণিতে পড়ে। সৌরভের মৃত্যুর পরে ক্ষতিপূরণ যা পাওয়ার তা তো পেয়েইছিলেন। এখন লড়ছেন ইএসআই-এর মাসিক পেনশনের জন্য। ‘‘এক বছর চাকরি করে মারা যাওয়ার পরে এক জন যদি পায়, আমার ছেলে দু’বছর চাকরি করার পরে কেন পাবে না?’’ প্রশ্ন বাবার।

২০১৩ সালে, ঘটনার তিন বছর পরে শৈলেনবাবু মামলা করেন পেনশনের জন্য। তাঁর কথায়, ‘‘মামলা শুরুর সময়ে তিন হাজার টাকা দিয়েছিলাম। প্রথম দেড় বছরে বার তিনেক শুনানি হয়েছিল। তাতে প্রতি বার আমার উকিলের পিছনে ৭০০ টাকা করে খরচ হয়েছে। এই তো ৬ ফেব্রুয়ারিও শুনানির দিন ছিল। কিন্তু শুনানি হয়নি। আবার নতুন করে ১৫ মে পরবর্তী শুনানির দিন পড়েছে।’’ ইএসআই থেকে তাঁকে বলা হয়েছে, যদি দেখা যেত, সৌরভের উপরে নির্ভরশীল কেউ রয়ে গিয়েছে পরিবারে, তা হলে পেনশন দেওয়ার প্রশ্ন আসত। কিন্তু শৈলেনবাবু নিজে চাকরি করেন। ফলে, সেই সম্ভাবনা নেই। তবে আদালত এখনও কোনও নির্দেশ দেয়নি। কবে সেই চূড়ান্ত নির্দেশ আসবে, তা নিয়ে পুরোপুরি অন্ধকারে শৈলেনবাবু।

তাঁর কথায়, এ ক্ষেত্রে টাকাটা নয়, বিচারটাই বেশি গুরুত্বপূর্ণ। সৌরভের মৃত্যুর পরে প্রতিনিয়ত তাঁর মনে হয়, তিনি কোথাও যেন বঞ্চিত। প্রতি মুহূর্তে একটা ‘না-পাওয়া’ তাড়া করে বেড়ায়। মনে হয়, তিনি বড়সড় একটা ‘অবিচারের’ শিকার। তাই কোথাও গিয়ে যেন জিততে চান। মনোরোগ চিকিৎসক সঞ্জয় গর্গের কথায়, ‘‘আক্ষরিক অর্থে ছেলের মৃত্যু মেনে নিতে পারেননি শৈলেনবাবু। তিনি বিচারপ্রার্থী। এই মামলাটার দ্রুত নিষ্পত্তি হওয়া প্রয়োজন। মামলা যত ঝুলে থাকছে, তত আরও বেশি চাপ তৈরি হচ্ছে তাঁর উপরে। হতাশা গ্রাস করছে। মামলা থেকে বেরিয়েও আসতে পারছেন না। ভাবছেন, বেরিয়ে এলে মৃত ছেলের প্রতি তিনি সুবিচার করবেন না।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন