কখনও রাস্তায় ধস। কখনও বা পাইপ ফেটে রাজপথে জল থইথই অবস্থা। শহরের ভূগর্ভের অবস্থা যে আদতে কী, তা জানা নেই কারও। ফলে ভূগর্ভে কোনও বিপর্যয় ঘটলে প্রশাসন কার্যত নিরুপায়।
এই সমস্যার সমাধানে পুরসভার তরফে বহু দিন আগে প্রকল্প গ্রহণ করা হলেও তা এখনও বাস্তবায়িত হয়নি। যদিও পুর-প্রশাসনের দাবি, প্রকল্পটি দ্রুত বাস্তবায়িত করার পরিকল্পনা রয়েছে। কলকাতার মেয়র শোভন চট্টোপাধ্যায় বলেন, ‘‘মাটির নীচের অবস্থা সম্পর্কে ওয়াকিবহাল থাকাটা অত্যন্ত জরুরি। ভূগর্ভস্থ অংশের ছবি তোলারও একটি পরিকল্পনা ছিল বহু আগে। কিন্তু তা বাস্তবায়িত করা যায়নি। এই ব্যাপারে দ্রুত সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। আলোচনা চলছে।’’
শহরের ভূগর্ভে সমস্যা কোথায়?
পুরসভা সূত্রে জানা গিয়েছে, কলকাতা ভারতের অন্যতম পুরনো শহর। পানীয় জলের লাইন ছাড়াও নিকাশি, বিভিন্ন কেব্লের লাইন ও টেলিফোনের লাইন গিয়েছে মাটির নীচ দিয়ে। এ শহরে কখনও নিকাশির পাইপ ফেটে মাটির তলা আলগা হয়ে যাওয়ায় রাস্তায় ধস নামে, তো কখনও পানীয় জলের পাইপ ফেটে গিয়ে জলের হাহাকার দেখা দেয়। মাটির উপরের কোন অংশ কোথায় কাটা উচিত বা উচিত নয়, কাটতে হলে কী ধরনের সাবধানতা অবলম্বন করা প্রয়োজন, তার কোনও নিয়মই মানা হয় না। শহরের মাটির নীচে কোথায় কী রয়েছে, তা জানা থাকলে অনেক আগেই ব্যবস্থা নেওয়া সম্ভব। সে ক্ষেত্রে ছোটখাটো সমস্যা তো বটেই, বড় কোনও দুর্ঘটনা থেকেও রক্ষা পেতে পারে এই শহর।
পুরসভার এক আধিকারিক জানান, ২০০০ সালে তৎকালীন মেয়র সুব্রত মুখোপাধ্যায়ের নেতৃত্বে তৃণমূল বোর্ড ক্ষমতায় আসার পরেই পুরসভা ভূগর্ভে সমীক্ষা করানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। ঠিক হয়েছিল, একটি বিদেশি সংস্থা ওই কাজ করবে। ওই সমীক্ষার মাধ্যমে পুরসভা যে ছবি পাবে, সেটিই শহরের ভূগর্ভের মানচিত্র হিসেবে ব্যবহার করা হবে। এই মানচিত্র অনুযায়ী পুরনো জলের পাইপ অথবা নিকাশি নালার পাইপ পাল্টালে বিপর্যয় আটকানো সম্ভব।
কিন্তু ওই সমীক্ষা হল না কেন?
পুরসভার মুখ্য ইঞ্জিনিয়ার নীলাংশুভূষণ বসু জানান, টাকার সমস্যা তো ছিলই। সঙ্গে যোগ হয়েছিল কিছু প্রযুক্তিগত সমস্যা। সে কারণে ওই সংস্থা পিছিয়ে যায়। নীলাংশুবাবু জানান, কলকাতার নীচে মাটির জলস্তর বেশি থাকায় স্পষ্ট ছবি পাওয়া সম্ভব ছিল না। সেটাও ওই বিদেশি সংস্থার পিছিয়ে যাওয়ার একটি কারণ। পরে অবশ্য কাজ বিশেষ এগোয়নি। বিশেষজ্ঞদের মতে, বর্তমানে এমন সমীক্ষার জন্য অত্যাধুনিক ক্যামেরাযুক্ত মই প্রয়োজন।
২০০৫ সালে বামফ্রন্ট কলকাতা পুরসভার বোর্ড গঠন করলেও তারা এই প্রকল্প বা এর কোনও বিকল্প ব্যবস্থা গ্রহণ করল না কেন?
তৎকালীন মেয়র বিকাশ ভট্টাচার্য বলেন, ‘‘এই প্রকল্পটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ছিল। কিন্তু অর্থাভাবেই আমারা পিছিয়ে যাই। দৈনন্দিন পরিষেবার যে কাজ, সে দিকেই আমরা বেশি গুরুত্ব দিয়েছিলাম। এমনকী, জওহরলাল নেহরু আর্বান রিনিউয়াল মিশন প্রকল্পে নিকাশির যে কাজ, তা আমাদের আমলেই হয়েছে।’’
নীলাংশুবাবু জানান, জেএনএনইউআরএম প্রকল্পে ভূগর্ভস্থ নিকাশি সংস্কারের সময়ে পুরসভার বাস্তুকারেরা ম্যানহোল দেখে একটি মানচিত্রের ছবি তৈরি করেছিলেন। কিন্তু যে অংশটুকুর কাজ হয়েছে, সেই মানচিত্র ওই অংশেই সীমাবদ্ধ। ফলত, শহরের অন্যান্য অংশের মাটির তলার কী অবস্থা, তা এখনও জানা সম্ভব হয়নি। পুর-কর্তৃপক্ষ জানান, ব্রিটিশ আমলে তো বটেই, কয়েক বছর আগেও নিকাশির লাইনে নৌকা চালিয়ে ভূগর্ভস্থ পাইপলাইনগুলি পরিদর্শন করা হতো। কিন্তু বেশির ভাগ পাইপলাইনে পলি পড়ে যাওয়ায় এখন সেই কাজও বন্ধ।
পুরসভার নিকাশি দফতরের এক আধিকারিকের কথায়, শহরে ইতিমধ্যে প্রায় ২৭ কিলোমিটার নিকাশির লাইনে জমে থাকা পলি যন্ত্রের মাধ্যমে পরিষ্কার করে তার সংস্কার সম্ভব হয়েছে। এ ছাড়া, শ্রমিক নামিয়ে আরও ১৫ কিলোমিটার নিকাশির সংস্কার করেছে পুরসভা। তবে, প্রয়োজনের তুলনায় তা যথেষ্ট নয়। শহরের আয়তনও এখন আগের চেয়ে বহুগুণ বেড়েছে। স্বাভাবিক ভাবেই, এই ধরনের ভূগর্ভস্থ সমীক্ষার গুরুত্বও বেড়েছে অনেক।