আরবের আবহাওয়ায় উলট-পুরাণ! প্রবল বৃষ্টিতে বানভাসি দুবাই ও আবু ধাবির মতো মরু শহর। জল থইথই কাতারের রাজধানী দোহাও। ফলে প্রবল দুর্ভোগের মুখে পড়েছেন পশ্চিম এশিয়ার বিস্তীর্ণ এলাকার বাসিন্দারা। বাড়ি থেকে বেরোলেই হয়রানির শিকার হতে হচ্ছে তাঁদের। শহরের ব্যস্ত রাস্তাগুলি এতটাই জলমগ্ন যে সেখানে গাড়ি চালানো দুষ্কর হয়ে দাঁড়িয়েছে। ফলে ঝাঁ-চকচকে উপসাগরীয় এলাকাগুলির পয়ঃপ্রণালী ও জল নিষ্কাশন ব্যবস্থা নিয়ে উঠে গিয়েছে প্রশ্ন।
চলতি বছরের ডিসেম্বরের দ্বিতীয় সপ্তাহে টানা কয়েক দিন বৃষ্টিতে ভিজেছে সংযুক্ত আরব আমিরশাহি এবং কাতারের মতো পারস্য উপসাগরের কোলের দেশ। কোনও কোনও জায়গায় বজ্রবিদ্যুৎ-সহ ভারী বর্ষণ প্রত্যক্ষ করেছে এই দুই আরব রাষ্ট্র। এর ফলে জলমগ্ন হয়ে পড়ে দুবাই, আবু ধাবি এবং দোহার মতো একাধিক গুরুত্বপূর্ণ শহর। ব্যাহত হয় স্বাভাবিক নাগরিক জীবন। ভারী বৃষ্টির প্রভাব পড়েছে অসামরিক বিমান পরিষেবাতেও।
স্থানীয় গণমাধ্যমগুলির প্রতিবেদন অনুযায়ী, প্রবল বৃষ্টির জেরে দুবাইয়ের আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের রানওয়েতে জল দাঁড়িয়ে যায়। ফলে বাধ্য হয়ে দীর্ঘ ক্ষণ বন্ধ রাখা হয় উড়োজাহাজের ওঠানামা। ওই সময় পর পর বেশ কয়েকটি বিমান বাতিল হওয়ায় প্রবল হয়রানির মুখে পড়েন যাত্রীরা। যাঁরা গাড়ি নিয়ে বেরিয়েছিলেন, তাঁরা অন্য দুর্ভোগের মধ্যে পড়েন। কিছু কিছু জায়গায় জমা জল গাড়ির দরজা পর্যন্ত উঠে যায়।
একের পর এক শহর জলবন্দি হওয়ায় নাগরিক সুরক্ষায় একাধিক অ্যাডভাইসরি জারি করে আমিরশাহি ও কাতার প্রশাসন। সেখানে খুব প্রয়োজন ছাড়া বাসিন্দাদের বাড়ি থেকে বার হতে বারণ করা হয়েছে। বৃষ্টির সময় দোহায় চলছিল ফিফা আরব কাপের প্লে অফ ফুটবল ম্যাচ। খেলোয়াড় বা দর্শকের উপর বজ্রপাতের আশঙ্কা থাকায় তড়িঘড়ি তা বন্ধ করেন আয়োজকেরা। এ ছাড়া একাধিক পার্ক-সহ শহরের ভ্রমণস্থলগুলিকেও বন্ধ রেখেছে দুবাই এবং আবু ধাবির প্রশাসন।
প্রতি বছর পশ্চিম এশিয়ার এই সমস্ত উপসাগরীয় দেশে বেড়াতে আসেন পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তের মানুষ। ডিসেম্বর পড়তে না পড়তেই পর্যটনে বিপুল লাভের আশায় যাবতীয় প্রস্তুতি সেরে ফেলে আমিরশাহি এবং কাতার। অসময়ের আচমকা বৃষ্টি তাতে যে বাদ সাধল, সে কথা বলাই বাহুল্য। তাৎপর্যপূর্ণ বিষয় হল, ঐতিহাসিক ভাবে আরবের এই জায়গা বেশ শুষ্ক এবং মরুভূমির অন্তর্গত। সেখানে বছরে হাতেগোনা কয়েকটা দিন হয় ছিটেফোঁটা বৃষ্টিপাত।
বিশেষজ্ঞদের অনুমান, জলবায়ু পরিবর্তনের জেরে উপসাগরীয় দেশগুলির চিরাচরিত সেই আবহাওয়াই এ বার বদলাতে শুরু করেছে। গত ১৮ অক্টোবর বৃষ্টির পাশাপাশি ঝড়ের মুখেও পড়ে আবু ধাবি। এর তীব্রতা এতটাই ছিল যে আমিরশাহির রাজধানী শহরটির বেশ কিছু জায়গায় ভেঙে উড়ে যায় বিজ্ঞাপনের ফ্লেক্স। ফলে পরের দিন জরুরি পরিষেবা বাদ দিয়ে অধিকাংশ সরকারি কর্মীকে বাড়ি থেকে কাজ (ওয়ার্ক ফ্রম হোম) করার নির্দেশ দেয় স্থানীয় প্রশাসন। একই রাস্তা অবলম্বন করে বেশ কিছু বেসরকারি সংস্থাও।
দুবাই, আবু ধাবি এবং দোহার বৃষ্টিপাত দেখে সেখানকার নাগরিকদের ইতিমধ্যেই সতর্কবার্তা পাঠিয়েছে একাধিক বিমা সংস্থা। সেখানকার বাসিন্দাদের যানবাহন রক্ষা করার পরামর্শ দিয়েছে তারা। তবে সংশ্লিষ্ট শহরগুলির জলমগ্ন হয়ে পড়া নিয়ে স্থানীয় প্রশাসনকে দোষ দিতে নারাজ বিশেষজ্ঞদের একাংশ। তাদের কথায়, ‘‘আবহাওয়ার এ-হেন আমূল বদল হবে, তা কখনওই আন্দাজ করতে পারেননি শহর নির্মাণকারী প্রকৌশলীরা। কম বৃষ্টিপাত হওয়ার কারণে কোনও জল নিষ্কাশন পদ্ধতি তৈরি করেননি তাঁরা, যার ফল আজ গতে হচ্ছে।’’
আবহাওয়ার এই পরিবর্তন গত বছর থেকে প্রত্যক্ষ করছে আবু ধাবি ও দুবাই। ২০২৪ সালের ডিসেম্বরেও ভারী বৃষ্টির কারণে জলবন্দি হয়ে পড়ে দুবাই। সেই জল নামতে চার থেকে পাঁচ দিন সময় লেগেছিল। সংশ্লিষ্ট উপসাগরীয় দেশগুলির জলবায়ু বদলে যাওয়ার জন্য একাধিক কারণকে চিহ্নিত করেছেন বিশ্লেষকেরা। তাঁদের দাবি, সাম্প্রতিক সময়ে দ্রুত গতিতে বাড়ছে পারস্য উপসাগরের তাপমাত্রা। ফলে সমুদ্রের উপরিভাগে তৈরি হচ্ছে নিম্নচাপ। এর জেরেই ভারী বর্ষণে ভিজছে আরবের যাবতীয় মরু শহর।
আবহাওয়াবিদদের দাবি, জলবায়ুর যে ভাবে বদল ঘটছে, তাতে আগামী দিনে ওই এলাকায় আছড়ে পড়তে পারে ঘূর্ণিঝড়ও। শুধু তা-ই নয়, দুবাই, আবু ধাবি, দোহায় আরও বাড়বে বৃষ্টিপাত। তা ছাড়া ভারী বর্ষণে হড়পা বান এবং কাদার স্রোত নামার আশঙ্কা বৃদ্ধি পাচ্ছে। সেই কারণে শহরের গঠনতন্ত্র বদলে ফেলার পরামর্শ দিয়েছেন তাঁরা।
দুবাই এবং আবু ধাবির মতো মরু শহরগুলিতে রয়েছে বহু গগনচুম্বী অট্টালিকা। শক্ত মাটির উপর সেগুলি গড়ে ওঠেনি। নরম বালিতে সংশ্লিষ্ট অট্টালিকাগুলিকে তৈরি করতে একাধিক প্রযুক্তি ব্যবহার করেছেন ইঞ্জিনিয়ারেরা। বিশেষজ্ঞদের একাংশের দাবি, পরিবেশ এবং তার বাস্তুতন্ত্রের উপর পড়েছে এর কুপ্রভাব। জলবায়ু পরিবর্তনের সেটাও একটা বড় কারণ হতে পারে বলে মনে করা হচ্ছে।
গত দু’বছর ধরে ডিসেম্বরের বৃষ্টিতে দুবাই এবং আবু ধাবির মতো শহরগুলিতে জল জমার সমস্যা বৃদ্ধি পাওয়ায় মাথায় হাত পড়েছে আমিরশাহি প্রশাসনের। পরিস্থিতির বদল ঘটাতে হলে চাই উন্নত জল নিষ্কাশন এবং পয়ঃপ্রণালী ব্যবস্থা, যেটা ঘনবসতিপূর্ণ ব্যস্ত শহরে তৈরি করা খুবই কঠিন। অন্য দিকে জল জমার সমস্যা বাড়তে থাকলে বেশ কয়েকটি চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে হবে স্থানীয় প্রশাসনকে, বলছেন বিশ্লেষকেরা।
বিশেষজ্ঞদের দাবি, ফি বছর ঝড়-জলের ঝাপ্টা লাগলে নষ্ট হবে দুবাই এবং আবু ধাবির স্বাভাবিক সৌন্দর্য। সেখানে বাড়ি কেনার উৎসাহ হারাতে পারেন ধনকুবেররা। তখন বাণিজ্যিক কেন্দ্র হিসাবে নিজেদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখা পশ্চিম এশিয়ার মরু শহরগুলির পক্ষে বেশ কঠিন হবে।
দ্বিতীয়ত, শীতের সময় বার বার দুবাই এবং আবু ধাবির মতো শহর জলমগ্ন হলে সেখানে দেখা দিতে পারে বিভিন্ন রোগের প্রাদুর্ভাব। জলবাহিত রোগ বাড়ার সবচেয়ে বেশি আশঙ্কা থাকবে। তা ছাড়া ক্ষতি হতে পারে সেখানকার গগচুম্বী অট্টালিকাগুলিরও। ভিত বসে যাওয়ার সমস্যা দেখা যেতে পারে সেখানে। এ ছাড়া আগামী দিনে বাড়িতে জল ঢুকলে আরব শেখদের দুর্ভোগ যে আরও বাড়বে তা বলার অপেক্ষা রাখে না।
২১ শতকে সবচেয়ে বড় পরিবেশগত বিপর্যয় দেখা গিয়েছে উজ়বেকিস্তানে। ২০১০ সাল নাগাদ মধ্য এশিয়ার দেশটির বিশাল এলাকা জুড়ে থাকা মিষ্টি জলের হ্রদ প্রায় শুকিয়ে গিয়ে বেরিয়ে আসে বালি। হ্রদটির নাম ছিল আরল সাগর। একসময় এখানে চলাচল করত বড় বড় জলযান। আরল সাগর বেয়ে উজ়বেকিস্তান থেকে যাওয়া যেত কাজ়াখস্তান পর্যন্ত।
৬৮,০০০ বর্গকিলোমিটার এলাকা জুড়ে বিস্তৃত মধ্য এশিয়ার ওই হ্রদটি ছিল বিশ্বের চতুর্থ বৃহত্তম জলাশয়। উত্তর থেকে দক্ষিণে প্রায় ৪৩৫ কিলোমিটার এবং পূর্ব থেকে পশ্চিমে ২৯০ কিলোমিটার লম্বা ছিল আরল সাগর। গত শতাব্দীর ৬০-এর দশকের গোড়া থেকে ধীরে ধীরে শুকোতে থাকে এর জল। সেচের জন্য যে নদীর জল ওই হ্রদে আসত সেগুলিকে অন্য দিকে ঘুরিয়ে দেয় তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়নের সরকার। এর জেরে কয়েক দশকের মধ্যে ঘটে যায় ভয়ঙ্কর ওই বিপর্যয়।
গত কয়েক বছরে আরও কয়েকটি জলবায়ুর পরিবর্তন প্রত্যক্ষ করেছেন গবেষক থেকে আমজনতা। উদাহরণ হিসাবে পশ্চিম ইউরোপের তাপপ্রবাহের কথা বলা যেতে পারে, যাতে গত বছরও (পড়ুন ২০২৪ সাল) ব্রিটেন, ফ্রান্স এবং জার্মানির মতো দেশগুলিকে পুড়তে দেখা গিয়েছে। ২০২৪ সালের জানুয়ারিতে বিশ্বের গড় তাপমাত্রা স্বাভাবিকের থেকে প্রায় দেড় ডিগ্রি বেড়ে গিয়েছিল। ইউরোপের একাধিক বনাঞ্চলে দাবানলের জন্য এই তীব্র তাপপ্রবাহকেই দায়ী করেছেন বিজ্ঞানীদের একাংশ।
আমেরিকার ক্ষেত্রে আবার দেখা গিয়েছে ঠিক এর উল্টো চিত্র। চলতি বছরে মাত্রাতিরিক্ত তুষারপাতে জমে যায় নিউ ইয়র্ক শহর। ২০২৩ সালে ভয়ঙ্কর তুষারঝড় আছড়ে পড়ে নিউ ইয়র্ক, ম্যাসাচুসেটস এবং নিউ হ্যাম্পশায়ারে। ওই সময় সংশ্লিষ্ট এলাকাগুলিতে তাপমাত্রা হিমাঙ্কের ৩০ থেকে ৪০ ডিগ্রি নীচে নেমে গিয়েছিল। ফলে স্বাভাবিক জনজীবন মারাত্মক ভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে। সংশ্লিষ্ট তুষারঝড়কে তাই ‘বম্ব সাইক্লোন’ বলে উল্লেখ করেন আবহাওয়াবিদেরা।
দুবাই বা আবু ধাবির হাওয়া অফিস অবশ্য এখনই কোনও ভাল খবর শোনাতে পারেনি। তারা জানিয়েছে, পারস্য উপসাগরের তাপমাত্রা যে ভাবে বাড়ছে তাতে আগামী দিনে আরও বেশি করে বজ্রবিদ্যুৎ-সহ ভারী বৃষ্টিপাত হতে পারে ওই সমস্ত মরু শহরে। ফলে পরিবেশ বদলের সঙ্গে সঙ্গে সেখানকার বাস্তুতন্ত্রেও একাধিক বদলে দেখতে পাওয়ার সম্ভাবনা থাকছে। সেই বদল কতটা ভাল বা খারাপ হবে, তার জবাব দেবে সময়।