অঙ্কন: ওঙ্কারনাথ ভট্টাচার্য
দুপুর তখন পৌনে একটা। সবে মাত্র মহাত্মা গাঁধী রোড স্টেশন ছেড়ে বেরিয়েছে দমদমগামী আপ মেট্রোটি। অন্ধকার সুড়ঙ্গে গতি তুলতেই চালক সমীর বন্দ্যোপাধ্যায়ের চোখে পড়ল, দূরে একটি থামের আড়ালে কী যেন নড়ে উঠল!
ভূত নাকি! এর আগে অনেক মেট্রো চালকই তো সুড়ঙ্গে ছায়ামূর্তি দেখেছেন। কেউ স্পষ্ট, কেউ বা আবছা। এটাও কি সেই রকমই কিছু? তত ক্ষণে ট্রেন আরও বেশ কিছুটা এগিয়ে গিয়েছে। সেই থামের কাছটায়। আর তখনই চালক টের পেলেন, ট্রেনের সামনে কিছু একটা সজোরে আছড়ে পড়ল!
ব্রেক কষা ছাড়া তখন আর সমীরবাবুর কিছু করার ছিল না। এবং তিনি সেটাই করলেন। এমার্জেন্সি ব্রেক কষে ট্রেন থামিয়ে দিলেন। কেবিনের দরজা খুলে নেমে পড়লেন লাইনে। প্রথমটায় কাউকে দেখতে পাননি। অগত্যা খবর পাঠালেন পিছনের মোটরম্যানকে। তিনিও এলেন। তত ক্ষণে পৌঁছে গিয়েছে আরপিএফের দলও। তখনই হঠাৎ ট্রেনের তলা থেকে বেরিয়ে এলেন এক মহিলা! তাঁর সারা গা দিয়ে তখন রক্ত ঝরছে! এবং ওই অবস্থাতেই তিনি দৌড়ে পালাতে যান। আর দেরি করেননি মহিলা আরপিএফ কর্মীরা। তিন-চার জন মিলে জাপটে ধরে তাঁকে নিয়ে আসেন প্ল্যাটফর্মে। প্রাথমিক চিকিৎসার পরে মহিলাকে তুলে দেওয়া হয় পুলিশের হাতে।
মেট্রো সূত্রের খবর, প্ল্যাটর্ফম ছেড়ে বেরিয়ে গতি বাড়ার প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই ব্রেক কষায় ট্রেনটির যাত্রীরাও কিছুটা হতভম্ব হয়ে যান। অনেকেই ভয় পেয়ে যান। ট্রেনের চারটি কামরা তত ক্ষণে সুড়ঙ্গে ঢুকে যাওয়ায় দরজা বন্ধই করে রেখেছিলেন চালক। ফলে যাত্রীরা কেউ লাইনে নামতে পারেননি। মেট্রো সূত্রের খবর, ট্রেনের ধাক্কায় ওই মহিলার বেশ কিছু জায়গায় কেটে গিয়েছে। প্রাথমিক চিকিৎসার পরে মহিলাকে তুলে দেওয়া হয় জোড়াসাঁকো থানার হাতে। পুলিশ সূত্রের খবর, বছর চল্লিশের ওই মহিলার বাড়ি বেলেঘাটা এলাকায়। খবর পেয়ে বাড়ির লোকেরা এসে তাঁকে নিয়ে গিয়েছেন। মানসিক অবসাদের জেরেই এ দিন মেট্রো লাইনে ঝাঁপ দিয়েছিলেন বলে পুলিশকে জানিয়েছেন মহিলার পরিবারের সদস্যরা।
কলকাতা মেট্রো রেলের জন্মলগ্ন থেকে এ পর্যন্ত লাইনে ঝাঁপ দিয়ে আত্মহত্যার সংখ্যা কম নয়। কিন্তু তাঁদের কেউই এ ভাবে সুড়ঙ্গে ঢুকে পড়েননি! এ বার সেটাই করে দেখালেন এই মহিলা। চালকের তৎপরতায় অবশ্য তিনি বেঁচে গিয়েছেন। তবে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছেন, মেট্রোর সুরক্ষা ব্যবস্থায় এখনও কত বড় সুড়ঙ্গ রয়েছে!
যাত্রীদের সুরক্ষা দিতে গত দেড় বছরে মেট্রোর বিভিন্ন প্ল্যাটর্ফমে বসানো হয়েছে সিসিটিভি ক্যামেরা। প্ল্যাটফর্মের দু’ধারে নিয়মিত টহলদারির ব্যবস্থাও করছে আরপিএফ।
ট্রেন প্ল্যাটফর্মে ঢোকার আগেই বাঁশি বাজিয়ে যাত্রীদের সচেতন করে দেন ওঁরা। এই ব্যবস্থাতেই মেট্রো-কর্তারা সন্তুষ্ট। কিন্তু কোথায় কী? সব ফাঁক গলে ওই মহিলা কী করে ভিতরে ঢুকে পড়লেন, এখন সেটাই ভাবাচ্ছে মেট্রো-কর্তাদের। পাশাপাশি অনেকেই বলছেন, জঙ্গিরাও যে এ ভাবে সুড়ঙ্গে ঢুকে পড়তে পারে, সেটাও চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিলেন ওই মহিলা। এই ঘটনার পরে মেট্রোর তরফে একটি তদন্তের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। ইতিমধ্যেই ওই সময় মহাত্মা গাঁধী স্টেশনের প্ল্যাটর্ফমের সিসিটিভি ফুটেজ খতিয়ে দেখছেন মেট্রো-কর্তারা।
কিছু দিন আগেই অন্য একটি ট্রেনের চালক সুড়ঙ্গে থামের পাশে এমনই কিছু একটা দেখে থামিয়ে দিয়েছিলেন ট্রেন। ওই ঘটনার পরে অনেকেই বলেছিলেন, সুড়ঙ্গে ভূতও হতে পারে! সোমবারের ঘটনার পর এখন তাঁরাই বলছেন, সে দিনও সম্ভবত এই রকমই কিছু ছিল! এবং সে কারণেই মেট্রো কর্তৃপক্ষ সম্ভবত ঘটনাটা চেপে গিয়েছিলেন!