দমদমে ফ্ল্যাট কিনছেন? ‘চাবি কন্ট্র্যাক্ট’ জানেন তো?

তৃণমূলের এক প্রভাবশালী নেতার ‘ঘনিষ্ঠ’ প্রোমোটার জানান, উত্তর দমদমে বছরে অনুষ্ঠান বাবদই ৪-৫ লক্ষ টাকা দিতে হয়।

Advertisement

সৌরভ দত্ত

শেষ আপডেট: ১৯ জুলাই ২০১৮ ০৪:২৭
Share:

ফাইল ছবি

শুধু বালি-পাথর-ইট কেনা নয়, তাঁদের ‘দাক্ষিণ্যে’ তৈরি হবে পুরো আবাসন। তার পর ফ্ল্যাট বিক্রির জন্য প্রোমোটারের হাতে চাবি তুলে দেবেন সিন্ডিকেটের লোকজন। এই ‘চাবি কনট্র্যাক্ট’ এখন বেশ ‘জনপ্রিয়’ দমদম এলাকায়।

Advertisement

আবার ‘প্যাকেজ-নেতা’ও আছেন। যিনি পুরসভায় প্ল্যান অনুমোদন থেকে বহুতল তৈরি, সব করিয়ে দেবেন। বিনিময়ে দিতে হবে মোটা অঙ্কের দক্ষিণা।

আবাসন নির্মাতাদের অভিযোগ, দমদমে বালি-পাথর-ইট সরবরাহের কারবার এখন সংগঠিত ব্যবসা। সেই ব্যবসার অঙ্গ হিসেবে বিভিন্ন চুক্তি এবং প্যাকেজের কথা শোনা যায় দমদম, উত্তর দমদম, দক্ষিণ দমদমে। স্থানীয় এক নির্মাণ ব্যবসায়ীর কথায়, ‘‘লাভ ও গুণমানের ব্যাপারে আপস করেও এই শর্ত মানতে হয়।’’

Advertisement

আবার, যেখানে এ ধরনের চুক্তি হয় না, সেখানে নির্মাণপর্বের প্রতি ধাপে সিন্ডিকেটের প্রাপ্য নির্দিষ্ট করা আছে বলে দাবি নির্মাতাদের। দেবেন্দ্রনগর এলাকার এক প্রোমোটার বলেন, ‘‘জমি কেনার পর কাউন্সিলরের অফিসে হাজিরা দিতে হয়। ওই অফিসেই ঠিক হয়, কোন প্রকল্পে কারা ইমারতি দ্রব্য সরবরাহ করবে। বর্গফুট-পিছু টাকার অঙ্কও সেখানে ঠিক হয়। আমি নিজেও তা করেছি। কিন্তু প্রমাণ তো থাকে না।’’ নাগেরবাজার অঞ্চলের এক প্রোমোটারের কথায়, ‘‘পূর্ত দফতরের তালিকা অনুযায়ী, বর্গফুট-পিছু দর হওয়ার কথা ১৭০ টাকা। অথচ সিন্ডিকেটের ভয়ে গড়ে ২৭০-২৮০ টাকা দরে নির্মাণ-সামগ্রী কিনতে বাধ্য হচ্ছি। কোথাও কোথাও ৩০০-৩২০ টাকা পর্যন্ত চাওয়া হচ্ছে। রাজি না-হলেই কাজ বন্ধ করে দেওয়ার হুমকি!’’

সিন্ডিকেটের সঙ্গে কাউন্সিলরের অফিসের ‘যোগাযোগের’ অভিযোগ খারিজ করে দিয়েছেন দমদমের বিধায়ক ব্রাত্য বসু। তাঁর পাল্টা প্রশ্ন, ‘‘কাউন্সিলররা যে সিন্ডিকেট চালাচ্ছেন, তার প্রমাণ কী?’’ রাজারহাট-গোপালপুরের বিধায়ক পূর্ণেন্দু বসুও বলেন, ‘‘মনিটরিং কমিটির মিটিংয়ে বলে দিয়েছি, কোনও কাউন্সিলর নিজের নামে, তাঁর পরিবারের কারও নামে বা আত্মীয়স্বজনের নামে কোনও ধরনের কনস্ট্রাকশন ইউনিট খুলতে পারবে না। এটা খুব কড়া ভাবে মানা হচ্ছে।’’ দক্ষিণ দমদম পুরসভার আটটি ওয়ার্ড রাজারহাট-গোপালপুর বিধানসভার অন্তর্ভুক্ত।

প্রোমোটারদের অবশ্য দাবি, শাসক দলের শীর্ষ নেতৃত্ব যতই প্রকাশ্যে বার্তা দিন, সিন্ডিকেট-দৌরাত্ম্য থামার নয়। নলতার এক ব্যবসায়ীর আবার অভিযোগ, কোনও কোনও কাউন্সিলরের অফিসে কাঠা-প্রতি নির্দিষ্ট টাকা দিতে হয়। ওয়ার্ড-ভিত্তিক সেই দর শেয়ার বাজারের মতোই ওঠানামা করে। প্রোমোটারদের একাংশের বক্তব্য, দক্ষিণ দমদমে বাগজোলা খালের ও-পারে দমদম স্টেশন সংলগ্ন ওয়ার্ডগুলিতে কাঠা প্রতি এই দর হল ১-২ লক্ষ টাকা। খালের অন্য পাশে ২ লক্ষ টাকা হল ন্যূনতম দর। দমদম এবং উত্তর দমদমের ক্ষেত্রে অঙ্কটা ৫০ হাজার থেকে ১ লক্ষ টাকা। এ ছাড়া রক্তদান শিবির, প্রবীণদের সংবর্ধনা, বস্ত্রদান, পুজোর চাঁদার দাবি মেটাতে হয় বলেও অভিযোগ।

তৃণমূলের এক প্রভাবশালী নেতার ‘ঘনিষ্ঠ’ প্রোমোটার জানান, উত্তর দমদমে বছরে অনুষ্ঠান বাবদই ৪-৫ লক্ষ টাকা দিতে হয়। দক্ষিণ দমদমের এক তৃণমূল কাউন্সিলর অকপট, ‘‘এত যে উৎসব, তার খরচ জোগাড়ে কোন প্রোমোটার কোথায় টাকা দেবেন, ঠিক করা আছে। অন্যদের মতো কাঠা-প্রতি টাকা বা ফ্ল্যাট নিই না!’’ দমদমে জোর
গুঞ্জন, সম্প্রতি সাতগাছি মোড় সংলগ্ন একটি ওয়ার্ডে কাউন্সিলরের আবদার শুনে আবাসন প্রকল্প থেকেই সরে যান এক প্রোমোটার। আবার কাঠা-প্রতি টাকা নেওয়ার পরে ওয়ার্ড অফিস তৈরির জন্য একতলার ঘর দিতে হয়েছে, দক্ষিণ দমদমে এমন নজিরও রয়েছে।

সব মিলিয়ে ভুগছেন ফ্ল্যাটের ক্রেতারা। সম্প্রতি দমদমে ফ্ল্যাট কিনেছেন তথ্যপ্রযুক্তি সংস্থার এক কর্মী। তাঁর আক্ষেপ, ‘‘দেওয়ালে পেরেক ঠুকলে বালি বেরিয়ে আসছে। প্রোমোটারকে বলে কোনও লাভ হচ্ছে না। কারণ, তিনি জানেন, দাদাদের আবদার মিটিয়ে দেওয়ার পরে তাঁর ভুলচুক আর ধরা হবে না।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন