প্রতিবাদ নেই, জলসায় গিয়ে তাই বন্ধ হয় না হেনস্থাও

মেদিনীপুরের এক জলসায় মঞ্চ পেতে একটু দেরিই হয়ে গিয়েছিল অষ্টাদশীর। পরিবেশ ততক্ষণে বেশ ‘গরম’। যে গানই শুরু করছেন, দর্শকেরা চিৎকার করে বলছেন, ‘এটা নয়, উগ্র গান চাই’। উগ্র শব্দটা কানে লেগেছিল সেই কিশোরী শিল্পীর। কম বয়সে এ হেন হেনস্থা সহ্য করতে না পেরে মঞ্চেই কেঁদে ফেলেছিলেন তিনি।

Advertisement

স্বাতী মল্লিক

শেষ আপডেট: ২১ নভেম্বর ২০১৮ ০০:০০
Share:

বাঁকুড়ার একটি গানের জলসায়। ফাইল চিত্র

মেদিনীপুরের এক জলসায় মঞ্চ পেতে একটু দেরিই হয়ে গিয়েছিল অষ্টাদশীর। পরিবেশ ততক্ষণে বেশ ‘গরম’। যে গানই শুরু করছেন, দর্শকেরা চিৎকার করে বলছেন, ‘এটা নয়, উগ্র গান চাই’। উগ্র শব্দটা কানে লেগেছিল সেই কিশোরী শিল্পীর। কম বয়সে এ হেন হেনস্থা সহ্য করতে না পেরে মঞ্চেই কেঁদে ফেলেছিলেন তিনি।

Advertisement

হলদিয়ায় একটি সংস্থার অনুষ্ঠানে গান গাইতে গিয়েও প্রায় একই অভিজ্ঞতা। এ বার মঞ্চের সামনে রাখা টেবিলে বসে মদ্যপান করছেন সংস্থার আধিকারিকেরা, কারও মুখে আবার নাচের গান শোনানোর আবদার। কিশোরী গায়িকাকে লক্ষ্য করে অশ্লীল অঙ্গভঙ্গি করতেও পিছপা হননি কেউ কেউ।

প্রায় ন’দশ বছর আগের ওই অভিজ্ঞতার কথা বলতে গিয়ে এখনও গলা ধরে আসে রিয়্যালিটি শো-খ্যাত শিল্পী তৃষা পাড়ুইয়ের। বললেন, ‘‘সে দিন আমায় কাঁদতে দেখেও দর্শকদের মন গলেনি। কারণ, ওঁরা তখন আর নিজের মধ্যে ছিলেন না।’’

Advertisement

দাঁতনে থানার অনুষ্ঠানে গিয়ে সঙ্গীতশিল্পী মেখলা দাশগুপ্তের হেনস্থা হওয়ার ঘটনা সোশ্যাল মিডিয়ায় ভাইরাল হলেও সঙ্গীতশিল্পীদের একাংশ জানাচ্ছেন, জলসা বা মাচার অনুষ্ঠানে গাইতে গিয়ে অপ্রীতিকর পরিস্থিতির মুখোমুখি হওয়া তাঁদের কাছে মোটেই নতুন নয়। কখনও শুনতে হয়— ‘শুধু গাইলে হবে, সঙ্গে একটু নাচতেও তো হবে!’ কখনও মঞ্চে উঠলেই উড়ে আসে ‘চিকনি চামেলি’, ‘নাগিন ডান্স’ কিংবা ‘কোকাকোলা’ গাওয়ার অনুরোধ। পছন্দের গা-গরম করা গান না গাইলে মঞ্চ থেকে নামতে দেওয়া হবে না— প্রচ্ছন্ন এই হুমকিও দিয়ে থাকেন দর্শকেরা। মঞ্চের নীচে মত্ত যুবকদের উদ্দাম নাচ উপেক্ষা করে দূরের দর্শকদের দিকে তাকিয়েই গান গেয়ে যেতে হয় তাঁদের।

মঞ্চে দাঁড়িয়ে কেমন লাগে তখন? তৃষা বলছেন, ‘‘এই ধরনের অনুরোধ মধ্যবয়স্করাই বেশি করেন। পঞ্চাশ বছরের কেউ যখন এসে বলেন ‘লড়কি বিউটিফুল কর গ্যয়ি চুল’ গাইতে, মনে হয় গান ছেড়ে দিই। এ তো নিজের শিক্ষাকেই নিজে অসম্মান করা।’’

কেন এ ভাবে হেনস্থা হতে হয় শিল্পীদের, বিশেষত মেয়েদের? সঙ্গীতশিল্পী ইমন চক্রবর্তীর ব্যাখ্যা, ‘‘পয়সা দিয়ে শিল্পীকে নিয়ে যাচ্ছেন বলে অনেকেই ভাবেন, যা গাইতে বলছি তা-ই গাইবে। কোন শিল্পী কী গান গেয়ে থাকেন, সেটা আয়োজকেরা মাথায় রাখেন না।’’ তাই তো মঞ্চে উঠে ‘বিড়ি জ্বলাইলে’ শোনানোর অনুরোধ আসে লোপামুদ্রা মিত্রের কাছে! অথবা হিউস্টনের অনুষ্ঠানে লোকগীতি গাইতে উঠলে ইমনকে অনুরোধ করা হয় পরপর নাচের গান গেয়ে যেতে। কী ভাবে সামলান? ইমন জানাচ্ছেন, মাথা গরম করে নয়, হেসে পরিস্থিতি সহজ করাই এ ক্ষেত্রে বিধেয়। ‘‘কখনও বলি, দাদা অনেক নেচে ক্লান্ত হয়ে গিয়েছেন, এ বার একটু বসুন! কখনও বুঝিয়ে বলি, অন্য দর্শকদের কথাও একটু ভাবুন, ওঁদের জন্য দু-একটা গান গেয়েই আবার নাচের গানে ফিরছি। এ সব বড়দের থেকেই শেখা’’— বলছেন ইমন।

অনেক সময়ে আয়োজকদের সঙ্গে শিল্পীদের যোগাযোগ করিয়ে দেন মধ্যস্থতাকারীরা। গাইতে গিয়ে কেমন পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হবে শিল্পীকে, তা নির্ভর করে তাঁদের উপরেই। শিল্পীর নিরাপত্তার দিকটাও দেখেন তাঁরা। কী ভাবে? ইভেন্ট ম্যানেজার বনি ঘোষের দাবি, ‘‘অনুষ্ঠানের আগে অনেক সময়েই এলাকা রেকি করি আমরা। তাতে দর্শক সম্পর্কে আন্দাজ পাওয়া যায়। অনুষ্ঠানের আগে আয়োজকদের সঙ্গে কথাবার্তার সময়েও বুঝে নেওয়ার চেষ্টা করি, তাঁরা কী চাইছেন। প্রয়োজনে চুক্তি বাতিলও করে দিই। অনেকেই এ ভাবে কাজ করেন না। তাই সমস্যা হয়।’’ কিন্তু মেখলা-পর্বের পরে এঁদের উপরেও আর চোখ বন্ধ করে ভরসা করতে চাইছেন না সঙ্গীতশিল্পীদের একাংশ। তার চেয়ে শিল্পীদের নিজেদের মধ্যে যোগাযোগ রেখে অনুষ্ঠান নিয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়াই সমীচীন বলে মনে করছেন তাঁরা।

লালবাজার অবশ্য জানাচ্ছে, যে কোনও অনুষ্ঠানস্থলেই পুলিশি নিরাপত্তা থাকে। আয়োজকেরা যোগাযোগ না-করলেও সেখানে মোতায়েন থাকেন পুলিশকর্মী ও মহিলা কনস্টেবল। কলকাতা পুলিশের যুগ্ম কমিশনার (অপরাধ দমন) প্রবীণ ত্রিপাঠী বলছেন, ‘‘অপ্রীতিকর কিছু ঘটলে উপস্থিত পুলিশকর্মীরাই ব্যবস্থা নিতে পারেন।’’ তবে বাস্তব বলছে, এ সব ক্ষেত্রে অধিকাংশ সময়েই সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেন পাশে দাঁড়ানো মিউজিশিয়ান এবং ওই অনুষ্ঠানে উপস্থিত অন্য সহশিল্পীরা।

আর প্রতিবাদ? সঙ্গীতশিল্পী অন্বেষার সাফ জবাব, ‘‘দর্শকেরও দায়িত্ব থাকে শিল্পীর প্রতি। সেই সম্মানটুকু না দিলে সঙ্গে সঙ্গে গান গাওয়া বন্ধ করে দেব।’’ তবে পরিস্থিতির মুখে অনেকে অবশ্য সেটুকুও করতে পারেন না। পারেন না পুলিশে যেতেও। ইমন বলছেন, ‘‘আজকের দিনে শুধু রেকর্ডিং করে রোজগার করা সম্ভব নয়। শো থেকেই আয় হয়। সেটা মাথায় রেখে কাজ করতে হয়।’’

তাই হেনস্থার এই ‘ট্র্যাডিশন’ও সমানে চলতেই থাকে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন