রোগীদের ফেরানোই যেন নিয়ম

শনিবার বিভিন্ন মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল ঘুরে করিমকে নিয়ে তাঁর পরিজনেরা যখন নীলরতন সরকার মেডিক্যাল কলেজে পৌঁছেছিলেন, তখন সেখানে বহুক্ষণ তাঁদের বসিয়ে রাখা হয়েছিল বলে অভিযোগ।

Advertisement

নিজস্ব সংবাদদাতা

শেষ আপডেট: ১৮ জুলাই ২০১৭ ০২:১৩
Share:

হয়রানি: ভর্তির অপেক্ষায় এসএসকেএমের বাইরে। ছবি: বিশ্বনাথ বণিক

সরকারি হাসপাতালে এখন ধনী-দরিদ্র নির্বিশেষে নিখরচায় চিকিৎসা শুরু হয়েছে। এসেছে নানা আধুনিক সরঞ্জাম। কিন্তু মুমূর্ষুকে প্রত্যাখ্যানের পুরনো ট্র্যাডিশন বন্ধ হয়নি। কী ভাবে সেটা বন্ধ করা সম্ভব, আপাতত সেই চিন্তায় জেরবার স্বাস্থ্য ভবন।

Advertisement

চোখে পেরেক ফোটা, আট বছরের করিম মোল্লার কলকাতার বিভিন্ন মেডিক্যাল কলেজে ঘুরে যে অভিজ্ঞতা হয়েছে, তা কি আদৌ কোনও নতুন ঘটনা? চোখ থেকে অঝোরে রক্ত পড়া শিশুটির চিকিৎসা শুরু না করে তাকে হাসপাতালে স্রেফ বসিয়ে রেখেছিলেন যাঁরা, এক হাসপাতাল থেকে অন্য হাসপাতালে তাকে রেফার করে যাঁরা দায়িত্ব সেরেছিলেন, তাঁরা কি সত্যিই অচেনা কেউ? সরকারি হাসপাতালে প্রতি দিন যে ভাবে অসংখ্য মুমূর্ষুকে ভর্তি না করে ফিরিয়ে দেওয়া হয়, এক হাসপাতাল থেকে অন্য হাসপাতালে যাওয়ার পথে যে ভাবে বহু রোগীর মৃত্যুর অভিযোগ ওঠে, তার ক’টি ক্ষেত্রে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয় স্বাস্থ্য দফতর? নাকি শুধু শাস্তি দিয়েই সমস্যার সমাধান সম্ভব? খোদ মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় করিমের বিষয়ে খোঁজ নেওয়ায় আরও নড়েচড়ে বসেছেন স্বাস্থ্যকর্তারা। কিন্তু যে ঘটনাগুলি সামনে আসে না, সেগুলির ক্ষেত্রে কী হবে? সোমবার নানা মহলে বারবার ঘুরেফিরে এসেছে এই প্রশ্ন।

শনিবার বিভিন্ন মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল ঘুরে করিমকে নিয়ে তাঁর পরিজনেরা যখন নীলরতন সরকার মেডিক্যাল কলেজে পৌঁছেছিলেন, তখন সেখানে বহুক্ষণ তাঁদের বসিয়ে রাখা হয়েছিল বলে অভিযোগ। পরে অন্য রোগীর পরিজনেরা কার্যত মারমুখী হয়ে উঠলে তড়িঘড়ি শিশুটির চিকিৎসা শুরু হয়। যাঁরা সে দিন প্রতিবাদ করেছিলেন, তাঁদের অন্যতম বসিরহাটের নান্টু শেখ। এ দিন তিনি বলেন, ‘‘বাচ্চাটাকে কাতরাতে দেখেও এক ডাক্তারবাবু বলেছিলেন, ‘ভিড় না কমলে দেখা যাবে না। সময় লাগবে। তাড়া থাকলে অন্য কোথাও চলে যাও।’ এটা শুনে আমরা অনেকেই স্থির থাকতে পারিনি। তেড়ে গিয়েছিলাম ওই ডাক্তারের দিকে। তার পরেই ভর্তির ব্যবস্থা হয়।’’ যদিও তার আগে এসএসকেএম, ন্যাশনাল মেডিক্যাল কলেজ, কলকাতা মেডিক্যাল কলেজ ঘুরে ফেলেছে ওই শিশু।

Advertisement

বিষয়টি সামনে আসায় এখন করিমের চিকিৎসায় মেডিক্যাল বোর্ড গঠিত হয়েছে। কিন্তু পরিস্থিতি যে আসলে বদলায়নি, তা মালুম হয়েছে এ দিন কলকাতার বিভিন্ন মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ঘুরে। ন্যাশনাল মেডিক্যালে সকাল থেকে হত্যে দিয়ে পড়ে থেকেও ভর্তির সুযোগ পাননি স্নায়ুরোগী তহমিনা বেগম। আরজিকরে মাথায় চোট পাওয়া সাত বছরের শিশু তুলি মণ্ডলকে ফিরিয়ে দেওয়া হয়েছে। হৃদ্‌রোগী শশাঙ্ক সরকারকে ফিরিয়ে দিয়েছে কলকাতা মেডিক্যাল কলেজ। প্রত্যেকটি ক্ষেত্রেই এক যুক্তি, শয্যা নেই। যদিও সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশ, কোনও গুরুতর রোগীকে ভর্তি না করে ফিরিয়ে দেওয়া যায় না। তা হলে কী ভাবে দিনের পর দিন সেটা করছে সব সরকারি হাসপাতাল?

দক্ষিণ হাবড়ার বাসিন্দা, ৭০ বছরের পুষ্প কর পড়ে গিয়ে ফিমার বোন ভেঙেছিলেন। সঙ্গে প্রবল জ্বর। প্রথমে হাবড়া হাসপাতাল, সেখান থেকে বারাসত হাসপাতালে তাঁকে রেফার করা হয়। বারাসত হাসপাতাল পাঠায় আরজিকরে। জ্বরের কারণে প্রথমে তাঁকে মেডিসিন ওয়ার্ডে ভর্তি করা হয়। তিন দিন সেখানে থাকার পরে জ্বর কমে। ডাক্তারেরা জানান, মেডিসিন ওয়ার্ড থেকে ডিসচার্জ নিয়ে অর্থোপেডিকে ভর্তি হতে হবে। কিন্তু অর্থোপেডিকে গিয়ে জানা যায়, শয্যা নেই। তত ক্ষণে মেডিসিন ওয়ার্ড থেকেও ছুটি হয়ে গিয়েছে ওই রোগীর। ফিমার বোন ভাঙা এক অশীতিপর বৃদ্ধাকে নিয়ে এক ওয়ার্ড থেকে অন্য ওয়ার্ডে ছোটাছুটি করেও ফল না হওয়ায় শেষ পর্যন্ত একটি বেসরকারি হাসপাতালে তাঁকে ভর্তি করেন বাড়ির লোকেরা। কিন্তু তত ক্ষণে তাঁর অবস্থার আরও অবনতি হয়েছে।

কেন এমন হয়রানি হবে রোগী ও তাঁর পরিজনদের? মেডিক্যাল কলেজগুলির দায়িত্বে থাকা রাজ্যের স্বাস্থ্য-শিক্ষা অধিকর্তা দেবাশিস ভট্টাচার্য স্বীকার করেন, বারবার হুঁশিয়ার সত্ত্বেও এমন ঘটনা এড়ানো যাচ্ছে না। তিনি বলেন, ‘‘বিষয়টির উপরে আমরা নজর রাখছি। শুধু শাস্তি দিয়ে এই রোগ উপড়ে ফেলা যাবে না। বিষয়টির গভীরে গিয়ে এর সমাধানের চেষ্টা চলছে।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন