ভেদরেখা মুছে মহরমের তাজিয়া সাজান সাগর

যিনি এই তাজিয়ার মসজিদ তৈরিতে ব্যস্ত, তিনি হিন্দু যুবক সাগর থাপা। আদতে নেপালি হলেও জন্ম এই নাজির লেনেই। ছোট থেকেই দুর্গাপুজো, কালীপুজো কিংবা জগদ্ধাত্রী পুজোর পাশাপাশি মহরম কিংবা ইদেও মেতে ওঠেন অনায়াসে।

Advertisement

দীক্ষা ভুঁইয়া

শেষ আপডেট: ২১ সেপ্টেম্বর ২০১৮ ০১:০৩
Share:

মসজিদের মডেল তৈরিতে ব্যস্ত সাগর থাপা (লাল জামা)। নিজস্ব চিত্র

ফুটবলের উপরে সোনালি রং করে তৈরি হচ্ছে গম্বুজ। আর শোলা কেটে গড়া হচ্ছে মসজিদের বাকি অংশ। তার সঙ্গে মানানসই আলোকসজ্জাও রয়েছে। চড়া গরমে ঘেমেনেয়ে মসজিদের ম়ডেলটি তৈরি করে চলেছেন লাল টি-শার্ট পরা বছর আটত্রিশের যুবক। মাথা তোলার সময়টুকুও নেই তাঁর। কাজ করতে করতেই সহকারীদের একের পর এক নির্দেশ দিয়ে চলেছেন তিনি। কারণ হাতে সময় খুব কম। তাই তাড়াতাড়ি শেষ করে ফেলতে হবে কাজাখস্তানের নুর আস্তানা মসজিদের আদলে তৈরি মসজিদের মডেলটি। আজ, শুক্রবার ওয়াটগঞ্জ এলাকায় মহরমের প্রধান আখড়া হিসেবে তাজিয়ার মিছিলে অংশ নেবে নাজির লেন।

Advertisement

কিন্তু, যিনি এই তাজিয়ার মসজিদ তৈরিতে ব্যস্ত, তিনি হিন্দু যুবক সাগর থাপা। আদতে নেপালি হলেও জন্ম এই নাজির লেনেই। ছোট থেকেই দুর্গাপুজো, কালীপুজো কিংবা জগদ্ধাত্রী পুজোর পাশাপাশি মহরম কিংবা ইদেও মেতে ওঠেন অনায়াসে। তবে মহরম এলে গত ছ’বছর ধরে সাগরের উপরে একটু বেশিই দায়িত্ব পড়ে। কারণ, তাঁর হাত ধরেই এখানকার তাজিয়া নিত্যনতুন সাজে সেজে ওঠে। এক কথায় বলতে গেলে, দুর্গাপুজোর মতো মহরমের তাজিয়াতেও ‘থিম’ ঢুকেছে সাগরের হাত ধরেই। গত ছ’বছর ধরে মহরমের ১০-১৫ দিন আগে থেকে তাই তাজিয়া সাজাতে ব্যস্ত থাকেন সাগর। সাগর আদতে ‘ট্যাটু’-শিল্পী। কিন্তু এই ক’দিন খাওয়া আর রাতের কয়েক ঘণ্টা ঘুম বাদ দিলে সারা দিনই তিনি ব্যস্ত থাকেন তাজিয়া তৈরিতে। তাঁকে বাদ দিয়ে তাজিয়া বার করার কথা ভাবতেই পারে না নাজির লেন।

আখড়ার উদ্যোক্তা মহম্মদ তারেক ও আলাউদ্দিন খানেরা জানালেন, সারা বছর ধরে সাগর বিশ্বের বড় বড় মসজিদের ছবি জোগাড় করেন। পরে সেই ছবি দেখে তিনি নাজির লেনের আখড়ার জন্য তৈরি করেন মডেল। যেটি মহরমের শেষ দিনে ওয়াটগঞ্জের রাস্তা ঘুরে কারবালায় পৌঁছয়।

Advertisement

হিন্দু হয়ে মহরমের তাজিয়া সাজান, এখন কোনও সমস্যা হয় না?

একেবারেই না। প্রায় সমস্বরেই জানিয়ে দিলেন সাগর, মহম্মদ তারেক, আলাউদ্দিন খান, আবদুল নাসিম, ইমরান খান-সহ অনেকে। কারণ, ছোটবেলা থেকেই এঁরা বন্ধু। সেই বন্ধুত্বে কে মুসলিম, কে খ্রিস্টান, কে হিন্দু— এ সমস্ত ভাবনা তো আগে কখনও আসেনি। মহম্মদ তারেক তো বলেই উঠলেন, ‘‘আমাদের তাজিয়ার একটা বড় টাকা আসে মিলন সঙ্ঘের পুজো কমিটির তরফে। আর সাগর? ওর জন্যই তো আমাদের তাজিয়া দেখতে এত লোক আসে! সেখানে হিন্দু-মুসলিম বলে কোনও ভেদাভেদ নেই!’’ আর আবদুল নাসিম বললেন, ‘‘আমরা কালীপুজো করি, জানেন।’’ আর এখানে পুলিশ-প্রশাসন যেমন বলে, সেই পথেই তাজিয়া বেরোয়।

কিন্তু পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে ধর্মের ভেদাভেদ বাধা হয় না? তারেক, আলাউদ্দিন, ইমরান একযোগে বলে উঠলেন, ‘‘দুর্গাপুজোই হোক বা মহরম— এই পাড়ায় আমরা সকলে সকলের পাশে দাঁড়াই। ধর্মের ভেদাভেদ মাথায় রাখি না। এটাই এই নাজির লেনের বৈশিষ্ট্য। বাইরের কেউ সেই ভেদাভেদের বিষ ঢোকাতে এলে আমরা জোটবদ্ধ হয়ে রুখে দাঁড়াব।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন