Teacher

গ্যারাজঘরের ক্লাসেই স্বপ্ন দেখাচ্ছেন দিদিমণি

গড়িয়ার বোড়াল মেন রোডের একটি আবাসনের খোলা গ্যারাজে সন্ধ্যায় বসে এই পাঠশালা। ২০১৪ সাল থেকেই তনুশ্রী রায় বাড়ির কাছে এক আদিবাসী এলাকার ছেলেমেয়েদের পড়াচ্ছেন।

Advertisement

আর্যভট্ট খান

কলকাতা শেষ আপডেট: ১০ অক্টোবর ২০২২ ০৭:১৪
Share:

পড়াশোনা: বোড়াল মেন রোডের গ্যারাজে ক্লাস চলছে। ছবি: দেশকল্যাণ চৌধুরী।

নবম শ্রেণির ছাত্রী তানিয়া ওরাওঁ পড়ছিল পদার্থবিজ্ঞানের অণু-পরমাণু বিষয়ক একটি অধ্যায়। ষষ্ঠ শ্রেণির মন্টি ওরাওঁ তখন আবার প্রাচীন ভারতের ইতিহাসের একটি অধ্যায় পড়ছিল। তানিয়া, মন্টির মতো বিভিন্ন শ্রেণির জনা সাতেক পড়ুয়া গোল হয়ে বসে তাঁদের তনুশ্রী দিদিমণির কাছে। পড়ুয়াদের এক জন রূপা ওরাওঁ আবার স্কুলের গণ্ডি পেরিয়ে এখন কলেজে পড়ছেন।

Advertisement

গড়িয়ার বোড়াল মেন রোডের একটি আবাসনের খোলা গ্যারাজে সন্ধ্যায় বসে এই পাঠশালা। ২০১৪ সাল থেকেই তনুশ্রী রায় বাড়ির কাছে এক আদিবাসী এলাকার ছেলেমেয়েদের পড়াচ্ছেন। নিজের ঘর-সংসার সামলানোর পাশাপাশি ছেলেকে পড়ানো এবং তাকে টিউশন ক্লাসে নিয়ে যাওয়ার ফাঁকেই তিনি চালাচ্ছেন আদিবাসী ছেলেমেয়েদের এই পাঠদান। সম্পূর্ণ বিনামূল্যে। তনুশ্রী বললেন, ‘‘করোনার সময়ে অনলাইন ক্লাসও করতে পারেনি এই গরিব ছেলেমেয়েরা। ওদের তো স্মার্টফোন নেই। তাই ওরা লেখাপড়ায় অনেকটা পিছিয়ে পড়েছে। এখন শুধু সন্ধ্যায় নয়, সকালেও সময় পেলে পড়াই।’’

কী ভাবে শুরু হল এই ক্লাস? তনুশ্রী জানালেন, তাঁদের আবাসনের খুব কাছেই একটি আদিবাসী পাড়া রয়েছে। সেই পাড়ার বাসিন্দা এক আদিবাসী মহিলা তনুশ্রীর বাড়িতে আসতেন পরিচারিকার কাজ করতে। ওই মহিলাই তনুশ্রীকে জানান, তাঁদের পাড়ায় বেশ কিছু এমন ছেলেমেয়ে আছে, যাদের পড়াশোনায় খুব উৎসাহ। স্কুলেও যায়। কিন্তু স্কুলের পড়া বাড়িতে ঠিক মতো দেখিয়ে দেওয়ার কেউ নেই। তাই ওরা পিছিয়ে পড়ছে। তনুশ্রী বলেন, ‘‘তখনই ঠিক করি, ওই ছেলেমেয়েদের পড়াব। ওদের কয়েক জনকে আমার বাড়িতে আসতে বলি। পরের দিনই ওরা বইখাতা নিয়ে চলে আসে। আমিও পড়াতে বসে যাই।’’

Advertisement

তনুশ্রীর প্রথম ছাত্রী ছিল, ওই আদিবাসী পাড়ারই লক্ষ্মী ওরাওঁ এবং তার বোন রূপা ওরাওঁ। লক্ষ্মী গত বছর পাটুলির কে কে দাস কলেজ থেকে স্নাতক হয়েছেন। লক্ষ্মীর দেখাদেখি রূপাও মন দিয়ে পড়াশোনা করছেন। তিনিও দিদির মতো কে কে দাস কলেজেই হিসাবশাস্ত্র নিয়ে পড়াশোনা করছেন।

লক্ষ্মী ও রূপার মা অনিতা ওরাওঁ জানান, তাঁর স্বামী রিকশা চালান। তিনি ভাবতেও পারেননি, তাঁর দুই মেয়ে কখনও কলেজে পড়বেন ও নিজেদের পায়ে দাঁড়ানোর চেষ্টা করবেন। অনিতা বলেন, ‘‘আমাদের তো মেয়েদের টিউশন ক্লাসে দেওয়ার সামর্থ্য নেই। তনুশ্রী দিদি বিনামূল্যে পড়ান বলেই পড়াতে পারছি। আমার দুই মেয়েকে দেখে আমাদের আদিবাসী পাড়ার অন্য ছেলেমেয়েরাও পড়ায় উৎসাহ পাচ্ছে। বিনিতা টিরকি, বিকাশ ওঁরাও-রা এখন স্কুলে যাচ্ছে। তনুশ্রীদির কাছে পড়তে আসে তারাও।’’ শুধু ওই আদিবাসী পড়ুয়ারাই নয়, তনুশ্রী যে আবাসনে থাকেন, সেখানকার নিরাপত্তারক্ষীর দুই মেয়ে অঞ্জু আর স্বপ্নাও পড়ে তাঁর কাছে।

ওই আদিবাসী ছেলেমেয়েরা সকলেই হিন্দি মাধ্যম স্কুলে পড়ে। তনুশ্রী জানালেন, তাঁর হিন্দি মাধ্যমে পড়াতে অসুবিধা হয় না। তাঁর কথায়, ‘‘আমি বরাবরই কেন্দ্রীয় বিদ্যালয়ে পড়াশোনা করেছি। তখন হিন্দি ভাল করে পড়েছিলাম। এখন ওদের পড়াতে গিয়ে আবার হিন্দিটা একটু ঝালিয়ে নিয়েছি। স্কুলে পড়া হিন্দি যে এমন কাজে লেগে যাবে, ভাবতে পারিনি।’’

ছেলে অনুভব অষ্টম শ্রেণিতে পড়ে। দু’বছর পরেই দশমের বোর্ডের পরীক্ষা। ছেলের পড়ার চাপ বাড়ায় তাকেও সময় দিতে হচ্ছে আগের চেয়ে বেশি। তাই মা যখন গ্যারাজে ক্লাস নেন, তখন অনুভবও মাঝেমধ্যেই সেখানে পড়তে বসে যায়। তনুশ্রী বলেন, ‘‘ছেলের পড়ার চাপ বাড়ছে। তা ছাড়া, সংসারের চাপও আগের থেকে অনেক বেড়েছে। কিন্তু তা বলে এই বাচ্চাদের পড়ানোকে অবহেলা করতে পারি না। ওদেরও কেউ মাধ্যমিক দেবে, কেউ উচ্চ মাধ্যমিক দেবে, কারও আবার কলেজের সিমেস্টারের পরীক্ষা সামনেই। তাই ওদের কথাটাও খেয়াল রাখতে হয়।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন