হরিদেবপুরের পানশালায় বচসার জেরে প্রকাশ্য রাস্তায় গুলি এবং এক যুবকের মৃত্যু। তাতেই টনক নড়ল লালবাজারের শীর্ষ কর্তাদের। আর তার জেরেই শনিবার থেকে ই এম বাইপাসের বেশ কিছু পানশালায় বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে গানের আসর। লালবাজার সূত্রে খবর, এ বার শহরের সব পানশালার লাইসেন্স সংক্রান্ত নথি আগে খতিয়ে দেখা হবে। যেগুলির বিরুদ্ধে বেআইনি ভাবে গান ও নাচের আসর বসানোর অভিযোগে রয়েছে, তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
কিন্তু এ ক্ষেত্রে প্রশ্ন উঠেছে পুলিশের ভূমিকা নিয়েই। কারণ, কলকাতায় বর্তমানে খাতায়-কলমে পানশালার সংখ্যা প্রায় ২০০। অভিযোগ, এর অনেকগুলিরই বাস্তবে আবগারি ও পুলিশ লাইসেন্স ছাড়া কিছু নেই। অনেক জায়গায় পুলিশের লাইসেন্সের মেয়াদও শেষ এবং পুনর্নবীকরণ করা হয়নি। তবু সেগুলি চলছে রমরমিয়ে। অভিযোগ, নাচ নিষিদ্ধ হলেও অনেক পানশালাতেই আইনকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে গানের পাশাপাশি বসে নাচের আসর। কিন্তু এত দিন তার বিরুদ্ধে কোনও ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। তাই হঠাৎ পুলিশের এই উদ্যোগে স্বভাবতই প্রশ্ন উঠেছে, হরিদেবপুরের ঘটনা না ঘটলে কি আদৌ এই বিষয়গুলি সামনে আসত?
হরিদেবপুরের ঘটনায় পানশালার লাইসেন্স না থাকা নিয়ে পুলিশি উদাসীনতার অভিযোগ উঠেছে আগেই। ঘটনার পরেই লালবাজারের কর্তারা জানান, আবগারি দফতরের লাইসেন্স থাকলেও পুলিশের লাইসেন্স নেই ওই পানশালার। অথচ, অবাধে চলছিল সেটি। পানশালাটির বেআইনি ভাবে চলার পিছনে পুলিশেরই মদত রয়েছে বলে অভিযোগ এলাকাবাসীর। তাঁদের দাবি, গত চার বছরে একাধিক অভিযোগ সত্ত্বেও ব্যবস্থা নেয়নি পুলিশ। যদিও গত বুধবার রাতের ঘটনার পরে ওই পানশালার বিরুদ্ধে অভিযোগ দায়ের হয়েছে। এর পরেই সোমবার বিকেলে চার অভিযুক্তকে গ্রেফতার করে পুলিশ। তাদের মধ্যে তিন জনকে বাংলাদেশ সীমান্তে হিঙ্গলগঞ্জ থেকে এবং এক জনকে কলকাতার প্রগতি ময়দান এলাকা থেকে অস্ত্র-সহ ধরা হয়।
লালবাজার সূত্রে খবর, আবগারি দফতরের লাইসেন্স ছাড়াও পানশালা ও তার সঙ্গে রেস্তোরাঁ চালাতে গেলে পুলিশের লাইসেন্স নিতে হয়। আর গানের আসরের ব্যবস্থা থাকলে গায়ক-গায়িকাদের নিতে হয় ‘ক্রুনার লাইসেন্স’ (পানশালায় গানের জন্য লাইসেন্স)। তবে নিষিদ্ধ হলেও যেমন এ শহরে নাচের আসর বসে, তেমনি অনেক পানশালার গায়ক-গায়িকাদের ক্রুনার লাইসেন্সও নেই।
লালবাজারের এক কর্তা জানান, আগে তা-ও নজরদারি রাখা হত। কিন্তু ২০১১-য় বেশ কিছু এলাকা রাজ্য পুলিশ থেকে কলকাতা পুলিশের অধীনে আসে। রাজ্য পুলিশের অধীনেও যেমন খুব একটা নজরদারি হত না, তেমনি কলকাতা পুলিশের অন্তর্ভুক্ত হয়েও লাভ হয়নি। সেই ফাঁকেই গজিয়ে উঠেছে নতুন নতুন পানশালা। বিশেষত ঠাকুরপুকুর, হরিদেবপুর, যাদবপুর, ইএম বাইপাস এলাকায়। সেখানে রাস্তার ধারে আবগারি দফতরের অনুমতি নিয়ে পুলিশি লাইসেন্স ছাড়াই রয়েছে একাধিক পানশালা। বুধবার হরিদেবপুর-কাণ্ডের জেরে এ বার সেই লাইসেন্স খতিয়ে দেখতে শুরু করেছে পুলিশ। তার জেরেই কয়েকটি পানশালায় বন্ধ হয়েছে গানের আসর।
প্রশ্ন উঠেছে এই এলাকাগুলি কলকাতা পুলিশের আওতায় এসেছে চার বছর। কিন্তু পুলিশ এত দিন কেন কোনও ব্যবস্থা নেয়নি? লালবাজারের এক কর্তার সাফাই, রাজ্য পুলিশের অধীনে পানশালা খুলতে গেলে শুধু আবগারি লাইসেন্স নিলেই চলত। কিন্তু কলকাতা পুলিশের নিয়ম ভিন্ন হওয়ায় ২০১৪-র নভেম্বরে একটি নির্দেশিকা জারি করে পুলিশ লাইসেন্স নেওয়া বাধ্যতামূলক করা হয়।
সম্প্রতি বাগুইআটি, দমদম, বিমানবন্দর থানা এলাকায় বিভিন্ন পানশালাকে কেন্দ্র করে গোলমালের পরে পুলিশি নজরদারি শুরু হয়। গত কয়েক মাসে পর পর অভিযান চালিয়ে বেআইনি ভাবে চলা একাধিক পানশালা বন্ধও করে দেওয়া হয়েছে বলে দাবি বিধাননগর পুলিশের। কিন্তু অভিযোগ, কলকাতা পুলিশের কাছে পানশালাগুলির বেআইনি কাজের অভিযোগ থাকলেও অজানা কারণে তারা কোনও ব্যবস্থাই নিতে পারেনি।
পুলিশের একটি সূত্রের দাবি, অনেক ক্ষেত্রে শাসক দলের চাপেই তারা ব্যবস্থা নিতে পারে না। অন্য দিকে, পুলিশের বিরুদ্ধেও রয়েছে এ ধরনের বিভিন্ন পানশালার সঙ্গে নানা রকম ‘লেনদেন’-এর অভিযোগ।
পুলিশের বিরুদ্ধে এই অভিযোগের উত্তরে সোমবার লালবাজারে পুলিশের এক শীর্ষ কর্তা বলেন, ‘‘নজরদারি থাকে। কিন্তু অনেক সময়ে স্থানীয় থানাগুলি নিজেদের মধ্যে বোঝাপড়া করে নেওয়ায় তা উপরতলায় এসে পৌঁছয় না।’’ তিনি আরও জানান, এ জন্যই ঠিক করা হয়েছে, প্রতিটি পানশালায় সব ধরনের নথি খতিয়ে দেখা হবে।
হরিদেবপুরের কবরডাঙার গুলি চলার ঘটনাতেও স্থানীয়দের অভিযোগ, ওই পানশালায় এর আগে একাধিক বার গোলমাল হয়। স্থানীয় থানা ও লালবাজারে অভিযোগ জমা পড়লেও লাভ হয়নি। স্থানীয়দের অভিযোগ, পানশালাটির মালিক অজয় মোদীর বদলে স্থানীয় বাসিন্দা দুর্গা সিংহ ও কালী সিংহ তা নিয়ন্ত্রণ করলেও সকলেই জানেন এর পিছনে শাসক দলের নেতাদের মদত রয়েছে। তাই পুলিশ এখানে নিষ্ক্রিয়ই থেকেছে।
এ দিকে, হরিদেবপুর-কাণ্ডের প্রেক্ষিতে সোমবার ব্যারাকপুরের পুলিশ কমিশনার নীরজ সিংহ জানান, প্রতিটি থানাকেই দু’মাস অন্তর পানশালাগুলির সমস্ত লাইসেন্স খতিয়ে দেখার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। পানশালার অনুমতির মেয়াদ উত্তীর্ণ হয়েছে কি না, নির্দিষ্ট সময়ের বাইরেও চালু থাকছে কি না, গায়িকার লাইসেন্স আছে কি না, তা-ও দেখার নির্দেশ দেওয়া রয়েছে থানাকে। এ ছাড়া, প্রতিটি পানশালার ঢোকার রাস্তায় সিসিটিভি লাগাতে বলা হয়েছে। নীরজ সিংহ বলেন, ‘‘আগে থেকেই পানশালার প্রতি নজরদারি চলছে। হরিদেবপুরের ঘটনার পরে ফের এই বিষয়গুলি থানাকে গুরুত্ব দিয়ে দেখতে বলা হয়েছে। তবে সাদা পোশাকের পুলিশ মাঝেমধ্যেই বিভিন্ন পানশালায় ঢুকে নজরদারি চালায়।’’
বিধাননগর পুলিশের এক কর্তা জানান, অনেক আগে থেকেই কমিশনারেট এলাকার পানশালাগুলির উপরে নজরদারি চলছে। নিয়ম ভেঙে যাঁরা পানশালা চালাচ্ছিলেন, সেখানে আইনি পদক্ষেপ করা হয়েছে। এ নিয়ে কিছু পানশালার মালিক আদালতেও গিয়েছেন। আইনি লড়াইয়ের পাশাপাশি পুলিশি নজরদারি অভিযানও চলছে।