পিঠ বাঁচাতেই কি লরির ত্রুটির কথা বলছে পুলিশ

এলাকাবাসীরা বলছেন, ‘তোলা’ না দিয়ে পুলিশ ভ্যানের তাড়া খাওয়া লরিটি গতি বাড়িয়ে পালাতে চেয়েছিল। যার জেরে সোমবার এত বড় দুর্ঘটনা ঘটে গিয়েছে।মঙ্গলবার অবশ্য ব্যারাকপুর এসিজেএম আদালতে দাঁড়িয়ে সরকারি আইনজীবী পল্লব চৌধুরী জানিয়ে দিলেন, লরির মাত্রাতিরিক্ত গতি ও যান্ত্রিক ত্রুটির কারণে দুর্ঘটনা ঘটেছে কি না, সেটাই খতিয়ে দেখা দরকার।

Advertisement

বিতান ভট্টাচার্য ও নির্মল বসু

শেষ আপডেট: ১৭ ফেব্রুয়ারি ২০১৬ ০৩:২৫
Share:

এলাকাবাসীরা বলছেন, ‘তোলা’ না দিয়ে পুলিশ ভ্যানের তাড়া খাওয়া লরিটি গতি বাড়িয়ে পালাতে চেয়েছিল। যার জেরে সোমবার এত বড় দুর্ঘটনা ঘটে গিয়েছে।

Advertisement

মঙ্গলবার অবশ্য ব্যারাকপুর এসিজেএম আদালতে দাঁড়িয়ে সরকারি আইনজীবী পল্লব চৌধুরী জানিয়ে দিলেন, লরির মাত্রাতিরিক্ত গতি ও যান্ত্রিক ত্রুটির কারণে দুর্ঘটনা ঘটেছে কি না, সেটাই খতিয়ে দেখা দরকার। কিন্তু কেন ওই লরি ‘মাত্রাতিরিক্ত গতি’তে ছুটল, সেই ব্যাপারে সরকারপক্ষ থেকে কোনও আলোকপাত করা হয়নি। আর লরির যান্ত্রিক ত্রুটি ঠিক কী ছিল, সে ব্যাপারেও মুখ খুলতে চায়নি পুলিশ। তারা জানিয়েছে, বিষয়টি তদন্তসাপেক্ষ।

তা হলে কি পুলিশের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন ওঠার কারণেই লরির যান্ত্রিক ত্রুটির তত্ত্ব সামনে আনা হচ্ছে?

Advertisement

ব্যারাকপুরের পুলিশ কমিশনার নীরজকুমার সিংহ বলেন, ‘‘পুলিশের বিরুদ্ধে টাকা চাওয়ার অভিযোগের কোনও প্রমাণ এখনও না পেলেও বিষয়টি খতিয়ে দেখা হচ্ছে।’’ ব্যারাকপুর কমিশনারেট সূত্রে খবর, আক্রান্ত পুলিশকর্মীদের বয়ান নেওয়া থেকে শুরু করে পুলিশের গাড়ির গতিপথ, গতিবেগ, অবস্থান এমনকী পুলিশের কর্তব্যে গাফিলতি হয়েছিল কি না, কন্ট্রোল রুমের রেকর্ড ও ঘটনাস্থলে থাকা পুলিশকর্মীদের বক্তব্যের সঙ্গে সব কিছু মিলিয়ে দেখা হবে বলেও জানা গিয়েছে।

সোমবার, দুর্ঘটনার কয়েক ঘণ্টা পর সিপি নীরজ সিংহই বলেছিলেন, ‘‘পুলিশের গাড়ির বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগ ভিত্তিহীন। কোনও অভিযোগ বা তথ্যপ্রমাণ না থাকায় পুলিশের বিরুদ্ধে বিভাগীয় তদন্তের কথা এখনই ভাবা হচ্ছে না।’’

সরকারের উপর মহল থেকে চাপের কারণেই ২৪ ঘণ্টার মধ্যে সিপি-র অবস্থান কিছুটা অন্য রকম হয়েছে বলে মনে করছে পুলিশ। কারণ, গোটা ঘটনা নিয়ে ডিজি-র কাছে রিপোর্ট চেয়েছেন স্বরাষ্ট্রসচিব।

তবে দুর্ঘটনার পরে পুলিশের একাংশ তোলাবাজির অভিযোগ ধামাচাপা দিতে যে মরিয়া হয়ে উঠেছে, তা স্পষ্ট। তদন্তকারীদের একাংশ যে কারণে দাবি করছেন, এক্সপ্রেসওয়েতেই লরিচালক বুঝতে পারেন, নিয়ন্ত্রণ হারাচ্ছেন। সামনে দাঁড়ানো বাসটিকে কোনও রকমে পাশ কাটালেও তার পরে আর গতি সামলাতে পারেননি। পিছনে থাকা আরএফএস-১৫ (রেডিও ফ্লাইং স্কোয়াড) গাড়িটিও প্রাণপণে ব্রেক কষে দাঁড়িয়ে যায়। সাব-ইনস্পেক্টর সুকুমার পাল ও তিন পুলিশ কর্মী গাড়ি থেকে নেমে বিষয়টি বুঝতে যেতেই পুলিশের উপরে চড়াও হয় জনতা।

চার নাবালককে পিষে দেওয়া লরিটির চালক পরিমল বিশ্বাসকে এ দিন আদালতে হাজির করানো হয়। সোমবার রাতে তাঁকে পুলিশ গ্রেফতার করে। সেই সঙ্গে পুলিশকে মারধর, পুলিশের উপরে ইটবৃষ্টি এবং পুলিশের দু’টি গাড়ি ভেঙেচুরে আগুন লাগানোর ঘটনায় অভিযুক্তদের ধরতে সোমবার বিকেল থেকে দুর্ঘটনাস্থল বেলঘরিয়া এক্সপ্রেসওয়ের উপরে রবীন্দ্রনগর ও আশপাশের বিভিন্ন তল্লাটে তল্লাশি শুরু করে পুলিশ। গ্রেফতার করা হয় ১১ জনকে। তাঁদেরও আদালতে এ দিন হাজির করানো হয়েছিল।

লরি চালকের বিরুদ্ধে অনিচ্ছাকৃত মৃত্যু ঘটানো ও বেপরোয়া গাড়ি চালানোর অভিযোগে মামলা রুজু করা হয়েছে। তাঁকে তিন দিনের জন্য পুলিশি হেফাজতে রাখার নির্দেশ দিয়েছেন বিচারক। পুলিশের উপরে হামলা চালানোর অভিযোগে ধৃতদের মাত্র এক জনকে বিচারক পুলিশি হেফাজতে পাঠিয়েছেন, এক জনকে জামিনে মুক্তি দেওয়া হয়েছে এবং বাকিদের তিন দিনের জন্য জেল হেফাজতে পাঠানো হয়েছে। তবে প্রত্যক্ষদর্শীদের মতে, যাঁদের গ্রেফতার করা হয়েছে, তাঁদের কেউ কেউ ঘটনাস্থলেই ছিলেন না ।

ধৃতদের অন্যতম, রঞ্জিত দাসের বাবা, রবীন্দ্রনগরের বাসিন্দা মুদি ব্যবসায়ী শম্ভু দাস বলেন, ‘‘আমার ছেলে নিমতায় থাকে। ঘটনা শুনে বিকেলে সাইকেল নিয়ে বাড়িতে এসেছিল। তার পরে ওই বাসস্টপে গিয়েছিল। ওঁকে তুলে নিয়ে গিয়েছে পুলিশ। এটা কি অন্যায় নয়?’’ আর এক ধৃত যুবক, বিজয় দাসের স্ত্রী মৌ দেবী বলেন, ‘‘রাতে পুলিশ এসে বাড়ির পিছনের পাঁচিল টপকে ভিতরে ঢোকে। দরজায় লাথি মারে। তার পরে আমার স্বামীকে পাঁজাকোলা করে তুলে নিয়ে যায়। হয়তো উত্তেজিত হয়ে কিছু বলেছে। নিজেও তো বাচ্চার বাবা।’’

ঘাতক লরির চালক পরিমল বিশ্বাসের বাড়ি বসিরহাটের ধলতিথা গ্রামের সবুজপল্লিতে। তবে তাঁর পরিবারের কেউ ভাবতেই পারছেন না, এমন দুর্ঘটনার সঙ্গে পরিমলের নাম জড়িয়ে যাবে। পরিমলের এক ছেলে ও এক মেয়ে। মেয়ে এ বার উচ্চ-মাধ্যমিক পরীক্ষা দিচ্ছে। বাবার নামের সঙ্গে মর্মান্তিক দুর্ঘটনার কথা জড়িয়ে যাওয়ার কথা জানাজানি হওয়া ইস্তক মেয়ে কার্যত বাকরুদ্ধ।

পরিমলের স্ত্রী মিতা বিশ্বাস বলেন, ‘‘স্বামীর লরির ধাক্কায় এক মহিলার কোল খালি হয়ে গিয়েছে, এ কথা নিজের কানই বিশ্বাস করতে চাইছে না।’’ সম্প্রতি পরিমলের বাবা মারা গিয়েছেন। গত রবিবার বাবার পরলৌকিক ক্রিয়া শেষ হয়। মিতা দেবী বলেন, ‘‘সবে দু’দিন হল, স্বামী কাজে যোগ দিয়েছেন।’’ সোমবার সন্ধ্যায় পরিমল মাত্র মিনিট পাঁচেকের জন্য বাড়ি ফিরলেও ফের বেরিয়ে যান। পরিবারের বক্তব্য, ওই সময়ে তিনি বলেছিলেন, ‘‘অনেক চেষ্টা করেও বাচ্চাগুলোকে বাঁচাতে পারলাম না।’’ তার পরেই পুলিশের হাতে ধরা দিতে বেরিয়ে যান পরিমল।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন