শুনতে পাননি ঘন্টি, মূক-বধিরকে ১০ ফুট হেঁচড়ে নিয়ে গেল ট্রাম

ঘন্টি বাজিয়ে দ্রুত গতিতে ছুটে আসছে ট্রাম। লাইনের একেবারে গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে এক তরুণী। তিনি বছর দশেকের এক বালিকার হাত ধরে রয়েছেন। ট্রামের ঘন্টির শব্দেও নড়ছেন না।

Advertisement

নিজস্ব সংবাদদাতা

শেষ আপডেট: ১৮ জানুয়ারি ২০১৭ ০১:২৪
Share:

এখানেই ঘটে দুর্ঘটনা। মঙ্গলবার। — নিজস্ব চিত্র

ঘন্টি বাজিয়ে দ্রুত গতিতে ছুটে আসছে ট্রাম। লাইনের একেবারে গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে এক তরুণী। তিনি বছর দশেকের এক বালিকার হাত ধরে রয়েছেন। ট্রামের ঘন্টির শব্দেও নড়ছেন না। ততক্ষণে চিৎকার শুরু করে দিয়েছেন আশপাশের লোকজন, ‘‘আরে সরে যান, সরে যান। মরবেন নাকি!’’ তবু সরছেন না তরুণী। তখনও কেউ জানে না, তিনি মূক ও বধির! এত আওয়াজ, চিৎকার কানেই যায়নি তাঁর।

Advertisement

ঘণ্টা বাজাতে বাজাতে একেবারে ঘাড়ের কাছে এসে পড়েছে ট্রামটি। তখন হতচকিত হয়ে সরে যাওয়ার মরিয়া চেষ্টা করলেন মহিলা। বাঁ হাতে দশ বছরের মেয়েকে ধরেই। কিন্তু ততক্ষণে মহিলার গা ঘেঁষে এগিয়ে গিয়েছে ট্রামের প্রথম কামরা। দ্বিতীয় কামরাটি আসার পরে সম্ভবত তরুণীর কাঁধের ব্যাগ বা ওড়না আটকে যায় ট্রামের সঙ্গে। তাতেই ঘটে বিপত্তি। প্রায় ফুট দশেক ট্রামের চাকার সঙ্গে ছেঁচড়ে যান তিনি। হাতে কিন্তু তখনও ধরা সন্তানের হাত। চাকার সঙ্গে মহিলার শরীরের ডান দিকটা দলা পাকিয়ে গেল। ট্রাম তখনও থামল না!

মঙ্গলবার সকালে এই ভয়াবহ দুর্ঘটনাটি ঘটেছে দেশপ্রিয় পার্কের কাছে রাসবিহারী অ্যাভিনিউ ও লেক ভিউ রোডের মোড়ে। জ্যোতি সিংহ (২৩) নামে মূক ও বধির ওই তরুণীকে আশঙ্কাজনক অবস্থায় রামকৃষ্ণ মিশন সেবা প্রতিষ্ঠানে ভর্তি করা হলেও শেষেমেশ বাঁচানো যায়নি। সন্ধ্যায় মারা যান তিনি। পুলিশ জানিয়েছে, জ্যোতির বাড়ি লেক মার্কেট এলাকায়। হাসপাতাল সূত্রে জানা গিয়েছে, ওই তরুণীর ডান পা গুঁড়িয়ে গিয়েছিল ট্রামের চাকায়। গুরুতর চোট ছিল বুকেও। জ্যোতির দশ বছরের মেয়ে সাক্ষীও চোট পেয়েছে, তবে তার আঘাত গুরুতর নয়।

Advertisement

জ্যোতি সিংহ

হাসপাতালে সাক্ষী এ দিন বলে, ‘‘চোখের সামনে দেখলাম মায়ের শরীরের অর্ধেকটা ট্রামের চাকার তলায় চলে গেল। মা-কে ট্রামটা ঘষটে নিয়ে যাচ্ছে। মায়ের হাত ধরে রাস্তায় ঘষে যাচ্ছি আমিও। কিন্তু শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত আমরা কেউ কারও হাত ছাড়িনি।’’ সাক্ষী জানায়, ঘণ্টার শব্দ সে শুনতে পেয়েছিল ঠিকই, তবে সেটা যে ট্রামের ঘণ্টি, তা বুঝতে পারেনি।

প্রত্যক্ষদর্শীরা জানিয়েছেন, এ দিন সকাল সাড়ে ন’টা নাগাদ দেশপ্রিয় পার্কের কাছে বছর দশেকের মেয়ের হাত ধরে জ্যোতি রাস্তা পেরোচ্ছিলেন। রাসবিহারী অ্যাভিনিউয়ের উপরে জোড়া ট্রামলাইনের প্রথমটা মা-মেয়ে পেরিয়ে যান। ওই লাইনে ট্রাম রাসবিহারী থেকে গড়িয়াহাটের দিকে যায়। সেই লাইন পেরোনোর পরেই খুলে যায় সিগন্যাল। তখন দ্বিতীয় ট্রাম লাইন অর্থাৎ রাসবিহারী মোড়মুখী ট্রামলাইনের ঠিক আগে মেয়েকে নিয়ে জ্যোতি দাঁড়িয়ে যান।

সিগন্যাল সবুজ দেখে ততক্ষণে গতি বাড়িয়েছে রাসবিহারী মোড়ের দিকে যাওয়া ট্রামও। কিন্তু ট্রামের ঘন্টি, এত চিৎকারের পরেও ওই মহিলা লাইন থেকে সরছেন না দেখে প্রথমটায় বিস্মিতই হয়েছিলেন প্রত্যক্ষদর্শীরা। পরে সত্যি জানার পরে সমবেদনায় ভেঙে পড়েন তাঁরা।

জ্যোতির স্বামী রণিত সিংহ পেশায় গাড়িচালক। বছর দেড়েক আগে ডেঙ্গিতে প্রথম স্ত্রী মারা যাওয়ার পরে মাস আটেক আগে জ্যোতিকে বিয়ে করেন তিনি। রণিতের প্রথম পক্ষের দুই ছেলেমেয়ে। জ্যোতি তাঁদের নিজের সন্তানের মতোই ভালবাসতেন। এ দিন এগারো বছরের ছেলে নীতীশ আর দশ বছরের মেয়ে সাক্ষীকে নিয়ে দেশপ্রিয় পার্কের কাছে একটি কোচিং সেন্টারে ভর্তি করাতে এসেছিলেন জ্যোতি। বাড়ি ফেরার পথে এই দুর্ঘটনা। রাস্তা পার হওয়ার সময়ে নীতীশ এগিয়ে গিয়েছিল। তাই সে বেঁচে যায়। দুর্ঘটনার কবলে পড়ে যায় মা ও মেয়ে।

আগে ট্রাম চলত বুলেভার্ডের উপর দিয়ে। কিন্তু পরবর্তীকালে বুলেভার্ড ভেঙে ট্রামলাইন সমান করে দেওয়া হয় মূল রাস্তার সঙ্গে। ফলে এখন ট্রাম ধরার জন্য যাত্রীদের অপেক্ষা করতে হয় মাঝরাস্তাতেই। এবং চলন্ত গাড়ির মধ্যে দিয়ে কোনওক্রমে প্রাণ হাতে করে গিয়ে থামাতে হয় ট্রাম। ফলে প্রতি মুহূর্তে থেকে যায় বড় ধরনের দুর্ঘটনার আশঙ্কা।

কিন্তু এ দিন ওই মহিলাকে ধাক্কা মারার পরেও ট্রাম থামল না কেন? পুলিশ জানিয়েছে, দেশপ্রিয় পার্ক থেকে রাসবিহারী মোড় পর্যন্ত চলে যাওয়ার পরে ট্রামটিকে ধরা যায়। পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য পরিবহণ নিগমের এক কর্তা বলেন, ‘‘আমি যত দূর খবর পেয়েছি, ওই ট্রামটির কোনও রকম যান্ত্রিক ত্রুটি ছিল না। তবু ধাক্কা লাগার পরেও সেটি থামল না কেন, তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন