আলিপুর এলাকার একটি মণ্ডপের সজ্জা। নিজস্ব চিত্র
মা দুর্গার পুজোয় থিম ঢুকেছিল বেশ কিছু বছর আগেই। এ বার তাঁর মেয়ের পুজোতেও থিমের ছড়াছড়ি! কোথাও থিমে ভগিনী নিবেদিতা, কোথাও বা সহজপাঠ। শুধু পাড়া বা বারোয়ারি পুজোতেই নয়, কোনও কোনও স্কুলের মণ্ডপেও থিমের লেগেছে ছোঁয়া। সাবেকি থেকে থিমে উত্তরণ নিয়ে দুর্গাপুজোয় কম বিতর্ক হয়নি। তা এখনও বহমান। বাগদেবীর আরাধনাতেও থিমের বাহুল্য নিয়ে শুরু হয়েছে বিতর্ক।
এন্টালির বিবেকানন্দ স্পোর্টিং ক্লাবের সরস্বতী পুজো থিমে সাজছিল। এ বার তাদের থিম ভগিনী নিবেদিতা। তাঁর জীবনী অনুসরণ করেই মণ্ডপ সাজিয়েছেন শিল্পী রণধীর ধর। মণ্ডপের চার পাশে ফুটে উঠেছে নিবেদিতার জীবনের নানা ঘটনা। নিউ ব্যারাকপুরের বি টি কলেজের কাছে একটি পুজোয় থিম হয়েছে সহজপাঠ। স্লেটের মতো ফ্রেমে ফুটে উঠেছে সহজপাঠের অক্ষর, ছবি। মধ্যমগ্রাম-সহ শহরতলির একাধিক স্কুলেও থিমের সাজ চোখে পড়েছে। অলিগলির ছোট পুজোতেও সেই দরমার মণ্ডপ, টবের সাজ বদলে যাচ্ছে ইন্টারনেট থেকে টুকে নেওয়া মডেলে।
এক সময়ে সরস্বতী পুজো পাড়ার কিশোর, তরুণ শিল্পীদের হাতেখড়ির মাঠ। দুর্গাপুজোর এক নামী শিল্পী তো ঘনিষ্ঠ মহলে মাঝেমধ্যেই বলেন, ‘‘আমার শিল্পী হওয়ার হাতেখড়ি তো কুমোরটুলিতে সরস্বতীর মূর্তি তৈরি, মণ্ডপ সাজানোর কাজ করে। শুধু তা-ই কেন, স্কুলের সরস্বতী পুজো বা যৌথ পরিবারের সরস্বতী পুজোতেও ভাই-বোন-বন্ধুরা মিলে পুজো সাজানো তো বাঙালি সমাজের রেওয়াজ ছিল। প্রবীণ মণ্ডপ শিল্পী দীপক ঘোষ স্মৃতি উস্কে বলছেন, ছোটবেলায় পাড়ার ক্লাবের সরস্বতী পুজো সাজাতে সাজাতেই তো শিল্পী হয়ে ওঠা। এখন দেখি, সরস্বতী পুজোতেও থিম মেকার, ইভেন্ট ম্যানেজমেন্টের ছড়াছড়ি।’’ তাঁর মন্তব্য, এই পুজো ছিল উঠতি শিল্পীদের হাত পাকানোর জায়গা। ভবিষ্যতের শিল্পীরা সেই জায়গা হারিয়ে ফেলছেন। মধ্য তিরিশের এক যুবকের আক্ষেপ, ‘‘পাড়ার সরস্বতী পুজো করতে গিয়ে কত দুষ্টুমি করেছি। এই প্রজন্মের ছেলেমেয়েদের কাছে সেই সব তো রূপকথা মনে হবে!’’
দীপকবাবুর মতো অনেকেই মনে করেন, বর্তমান সমাজ ব্যবস্থাই এর পিছনে দায়ী। কারণ, এক দিকে নিউক্লিয়ার পরিবারে এক সন্তানের উপরে বাবা-মায়ের চাপিয়ে দেওয়া কেরিয়ারের চাপ, অন্য দিকে সরস্বতী পুজোতেও বিজ্ঞাপনের হাত ধরে অর্থের প্রাচুর্য। ফলে নিজে সাজানোর বদলে টাকা দিয়ে শিল্পী ভাড়া করা হচ্ছে। অনেকেই বলেন, সাবেকি পুজোর ঘরানা থেকে থিমে বদলের পিছনে আর্থ-সামাজিক কারণ দায়ী। সমাজ ও পরিবার ব্যবস্থায় বিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে সেই ক্লাব সংস্কৃতি, পাড়া সংস্কৃতি বদলে যাচ্ছে। হারিয়ে যাচ্ছেন সেই আপাত রাগী কিন্তু স্নেহশীল পাড়াতুতো কাকা, জেঠারাও।
দক্ষিণ কলকাতার ছবিও খানিকটা একই। বালিগঞ্জ গভর্নমেন্ট স্কুলের থিম আদিবাসীদের হস্তশিল্প। সন্তোষপুর এলাকাতেও বহু সাবেক সরস্বতী পুজো থিমের দখলে চলে এসেছে। তবে দুর্গাপুজো থিম নির্ভর করলেও, সরস্বতী পুজোয় এখনও সাবেকি হরিদেবপুরের অজেয় সংহতির সরস্বতী পুজো। ক্লাবকর্তা হিল্লোল বসু বললেন, ‘‘সরস্বতী পুজোয় একটা ঘরোয়া ব্যাপার আছে। এখানে আধুনিক পরীক্ষানিরীক্ষা চাইনি।’’
তবে বাঙালির পরিচিত সরস্বতী পুজোর আবেগটা বদলে যাওয়ার আশঙ্কাকে সরিয়ে রাখছে বেশ কিছু স্কুলের ছাত্রছাত্রীরা। হিন্দু স্কুলে যেমন এখনও ছাত্রেরাই পুজোর দায়িত্বে। সকাল থেকেই হইহই চলছে সেখানে। বারাসতের প্রিয়নাথ গার্লস স্কুলেও শনিবার তোড়জোড় শুরু হয় পুজোর। সকাল থেকেই দিদিমণি-ছাত্রীদের ছুটোছুটি। ওই স্কুলের এক শিক্ষিকা বলছেন, “এই সময়ে দিদিমণি ও ছাত্রীরা একসঙ্গে পুজোর জোগাড় করেন, আলপনা দেন। শুধু তা-ই নয়, এই স্কুলে পুজোর জোগাড়ে প্রতীক্ষা সাহা, প্রিয়াঙ্কা কুণ্ডু, সুহানা রহমান, মোমেনা খাতুনে ভেদ থাকে না।”
এ সব দেখে শিল্পীদেরই অনেকে বলছেন, থিমের বাহুল্যেও যেমন বাগবাজার, ম্যাডক্সের দুর্গাপুজো স্বকীয়তা বজায় রেখেছে, তেমনই বাগদেবীর পুজোতেও হিন্দু, প্রিয়নাথের মতো স্কুলের হাত ধরেই বজায় থাকবে বাঙালির সারস্বত সংস্কৃতি।