জীবন মানেই চলার পথে পায়ে পায়ে ফেলে আসা চেনা পথঘাট, মানুষজন, পরিবেশ। সেখানে থেমে যাওয়া নিষেধ। তাই আমাদের কাছে ফিরে দেখতে চাওয়া মানেই পুজো, আর পুজো মানেই শিকড়ে ফেরা। উজান ঠেলে যেই পিছিয়ে যাই দশক থেকে শতক, দ্রুত বদলে যায় পথঘাট, পরিবেশ। শুধু অবিচল থাকে জীবনের স্রোত। কারণ সে চির বহমান।
এমনই এক ‘স্রোতের পাঁচালি’ এ বার শোনাবে বৈষ্ণবঘাটা পশ্চিমপাড়া সর্বজনীন দুর্গোৎসব। আদিগঙ্গা নামে ভাগীরথীর এই শাখা এক কালে ছুঁয়ে যেত দক্ষিণ শহরতলির কিছু জনপদকে। কথিত আছে, এই স্রোতেই লখিন্দরকে নিয়ে ভেলা ভাসিয়েছিল বেহুলা। সুন্দরবনের বাঘও বশ মানে যে দক্ষিণরায়ের পদতলে তাঁর মন্দির আজও নিশ্চুপে দাঁড়িয়ে আদিগঙ্গার পাড়েই। কিন্তু দূষণ আর নাগরিক নির্মাণের প্রয়োজনে সেই স্রোত আজ শীর্ণকায়। রুদ্ধ হচ্ছে জলের গতি, আর মুছে যাচ্ছে নদীপাড়ের ইতিহাস। সেই ইতিহাসকে ফিরে দেখতেই ময়ূরপঙ্খী নৌকোর আদলে তৈরি হচ্ছে মণ্ডপ। নদীপাড়ের গল্পকথার ওলাবিবি, বনবিবির মূর্তি, কুলুঙ্গি, পোড়ামাটির ঘোড়া উঁকি দেবে মণ্ডপের ইতিউতি। সাবেক প্রতিমা মূর্ত হবে জলে ভাসমান কলার ভেলার উপরে। আর জলে ভেসে থাকা অজস্র প্রদীপের আলোয় উজ্জ্বল হয়ে উঠবে পুজো প্রাঙ্গণ।
আমাদের মননে দেবী শুধু অসুরবিনাশী না, তার তেজরশ্মি দূর করে সকল অজ্ঞানতাকেও। কাঁকুড়গাছির মিতালি-র মণ্ডপে তাই দেবী ‘জ্যোতির্ময়ী মা’ রূপে আবির্ভূতা। মণ্ডপ হবে সূর্যের মতো। ভিতরে দেবীমূর্তি থেকে উদ্ভূত হয়ে আলো ছড়িয়ে পড়বে চতুর্দিকে। কখনও সেই আলোয় প্রকাশ পাবে রামধনু, কখনও বা সেই আলোই ঝড়ে পড়বে বৃষ্টির মতো। দেবীর আলোয় বিশ্ব বর্ণময়, তাই এখানে তিনি সংহার রূপ ত্যাগ করে বিরাজ করবেন বরাভয় মুদ্রায়। সমাহিত রূপেই দেবীর দেখা মিলবে পঁচিশপল্লি সর্বজনীন দুর্গোৎসব সমিতির পুজোতেও। মণ্ডপের বাইরের অংশে তৈরি হচ্ছে নরক। সেখানে থাকবে অসুররূপী ষড়রিপু। আর ভিতরে বৌদ্ধ মন্দিরের আদলে হচ্ছে কল্পিত স্বর্গ। সেখানে দেবীর দশ হাতে অস্ত্রের বদলে থাকবে পদ্ম। অহিংসার বাণী শোনাবে রূপচাঁদ মুখার্জী লেন সর্বজনীন দুর্গোৎসব-ও। দেবী দুর্গার হাতে অস্ত্রের বদলে থাকবে বাঁশি। শান্তির বার্তা ছড়িয়ে দিতে দেবী বিরাজ করবেন এক বিশালাকার পদ্মের উপরে। অসুরও এখানে হিংসা পরিত্যাগ করে নিরস্ত্র।
দেবী যেখানে বিরাজ করেন তাই তো মন্দির। তাই পুজো ভাবনায় মন্দির বাদ যায় না কোনও বছরই। নাকতলা সম্মিলনীর পুজোপ্রাঙ্গণে প্রাণ পাচ্ছে দুর্গেশ্বরী মন্দিরের আদলে মণ্ডপ। প্রতিমা হবে সাবেক। বড়িশা উদয়ন পল্লি সর্বজনীন-এর পুজোয় শিল্পীর কল্পনায় তৈরি হচ্ছে হর-পার্বতীর জোড়া মন্দির। এখানে শিব থাকবেন নীলকণ্ঠ হয়ে। আর দেবী দুর্গা হবেন অষ্টাদশভূজা। দু’টি মন্দিরের মাঝে থাকছে নাটমন্দির, সেখানে সারা দিন ধরে চলবে লোকসঙ্গীতের অনুষ্ঠান। যাদবপুরের শ্যামাপল্লি শ্যামাসঙ্ঘ সর্বজনীন দুর্গাপূজা কমিটির এ বছরের থিম ‘বর্ণযাত্রা’। জীবন মানেই হরেক রঙের মিশেল। উৎসব থেকে জীবনের রং সবটাই ফুটে উঠবে মণ্ডপ জুড়ে।
উত্তর কলকাতার বৃন্দাবন মাতৃ মন্দির-এর পুজো এ বার পা রাখবে ১০৫ বছরে। মণ্ডপ জুড়ে থাকবে পল্লিবাংলার আন্তরিকতা। গ্রামে গ্রামে এক সময়ে চণ্ডীমণ্ডপে হত বাঙালির প্রাণের পুজো। তাকেই ফুটিয়ে তুলতে খেজুর গাছে হাঁড়ি বেঁধে রস আহরণ, মাটির পুতুলের সাজ, লণ্ঠন আর চাঁদোয়ায় তৈরি হচ্ছে গ্রামের পরিবেশ। প্রতিমা সেজে উঠবে সলমা জরি আর চুমকি বসানো ডাকের সাজে। সরকার বাজারের ‘বিবেকানন্দ সঙ্ঘ’র পুজোর এ বার ৬৬ বছর। এখানেও ফিরে দেখার পালা পুরনো ঐতিহ্যকে। তাই কাপড়ে কুচি দিয়ে নকশা গেঁথে সাজানো হবে ঠাকুরবাড়ির দালানের আদলে তৈরি মণ্ডপ। ‘পুরনো সেই দিনের কথা’ মনে করিয়ে দেবে ডাকের সাজ। আবহে থাকবে টুসু-ভাদু আর নানা লোকসঙ্গীত।
বিশ্ব জুড়ে আগ্রাসী শিল্পায়নের দাবি মেটাতে ক্রমশ হারিয়ে যাচ্ছে ছায়া সুনিবিড় ছোট ছোট গ্রামগুলি। তাই প্রতি বারের মতো এ বছরেও শহরের বহু পুজোমণ্ডপে ক্ষণিকের অতিথি হয়ে আসছে গ্রামজীবন। হরিদেবপুর আদর্শ সমিতির পুজোমণ্ডপে মাটির ঘর, পুকুর ভরা মাছ, ধান, তুলসী মঞ্চের মাঝে দাঁড়িয়ে মনে হবে হঠাৎ যেন চলে এসেছি শহর থেকে অনেক দূরে। লালপেড়ে সাদা শাড়ি পরিহিত দেবী বিরাজ করবেন সাধারণ মায়ের রূপে। পাইকপাড়া ১৩ নম্বর পল্লিবাসী দুর্গোৎসব কমিটির মণ্ডপেও তৈরি হচ্ছে এক খণ্ড সাঁওতাল গ্রাম। ধামসা মাদলের দ্রিমি দ্রিম আর সাঁওতাল মেয়ের রূপে দেবীমূর্তির উপস্থিতি মূহূর্তে পৌঁছে দেবে অনন্য এক পরিবেশে। মাটির পুতুল, আঁকার ব্যবহারে মূর্ত হবে সাঁওতালদের জীবনযাত্রাও।
পুজো মানে শুধু ফিরে তাকানোই নয়, ফিরে পাওয়াও। এর সঙ্গে জড়িয়ে থাকে জীবনের ফেলে আসা প্রত্যেকটি মুহূর্ত। আর থাকে আশা স্মৃতিতে আবছা হয়ে আসা স্বজন হঠাৎ কোনও এক মণ্ডপের ভিড় ঠেলে এসে পিঠে হাত রেখে বলবে ‘কত দিন পরে দেখা হল’।