সর্বনাশা: নেশায় বুঁদ তরুণ প্রজন্ম। ছবি: দেশকল্যাণ চৌধুরী
এঁরা কেউ ছোটবেলায় লীলা মজুমদার, সুকুমার রায়, উপেন্দ্রকিশোর, অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর পড়েছেন? এক মা হাত তুলে জানালেন, তাঁর ছেলে পড়েছেন। বাকিদের বেশির ভাগই পড়েননি। তবে খেলা, গান-বাজনা— সে সব ছিল অধিকাংশের ক্ষেত্রেই।
তবে কি বাড়িতে বাবা-মায়ের মধ্যে সম্পর্কের টানাপড়েন প্রভাব ফেলেছে? হাত উঠেছে একটি, দু’টি। অর্থাৎ, বাকিদের ক্ষেত্রেও একাকিত্ব কিংবা পারিবারিক জটিলতা সমস্যার কারণ নয়।
নেশামুক্তি নিয়ে এক আলোচনায় উঠে আসছিল এমনই নানা প্রশ্ন, নানা কথা। কোথাও অঢেল টাকার জোগান সাহস জুগিয়েছে তরুণ-তরুণীদের, কোথাও আবার একমাত্র সন্তানের একাকিত্বই কারণ। এমনও উদাহরণ রয়েছে, যেখানে পাইলট হতে চেয়েছিলেন যুবকটি। সেই স্বপ্ন পূরণ না হওয়ায় শুরু হয় মানসিক অবসাদ। সেখান থেকেই নেশা। কোনও কোনও ঘটনা এমনও আছে, যেখানে স্রেফ কৌতূহল থেকেই নেশার শুরু। কোথাও বন্ধুরা নেশায় উৎসাহ দিয়েছেন, কোথাও বন্ধুরা সতর্ক করে সরেও গিয়েছেন। এ ভাবেই উচ্চবিত্ত, উচ্চ-মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তানদের সঙ্গী হয়েছে মাদকদ্রব্য।
তবে কিশোর বয়স থেকে মাদকের নেশায় ডুবে যাওয়ার ক্ষেত্রে এমন প্রতিটি ঘটনাই স্বতন্ত্র। কেন এঁরা নেশার কবলে পড়েছেন, তার কোনও একটি নির্দিষ্ট কারণ খুঁজে পাওয়া দুষ্কর বলে মনে করেন মনোরোগ চিকিৎসকেরাও। ফলে নেশার কবল থেকে বার করে আনার পদ্ধতিও এক-এক জনের ক্ষেত্রে এক-এক রকম।
আরও পড়ুন: ‘নেশার টানে বাড়িতেই চুরি করতে শুরু করি’
শহরে একটি নেশামুক্তি কেন্দ্র চালান শুভাশিস নাথ। বহু কিশোর-তরুণের দেখভাল করেন তিনি। তাঁর কথায়, ‘‘কোথাও যেন অভিভাবক আর সন্তানদের মধ্যে যোগাযোগে ফাঁক থেকে যাচ্ছে। সেটাই সমস্যার কারণ।’’ তাঁর অভিযোগ, টাকা দিয়ে, জিনিস দিয়ে এই ফাঁক পূরণ করতে চাইছেন অনেকে। তবে তিনিও জানেন, এটাই একমাত্র কারণ নয়।
শহরেরই আর একটি নেশামুক্তি কেন্দ্রের কর্ণধার কে বিশ্বনাথের মতে, জীবনযাপনের ধরনটাই তো বদলে যাচ্ছে। রেভ পার্টি, অসংখ্য পাব, বার, ডিস্কো, রাতে ফাঁকা রাস্তায় রেস— এ সবই পরিবর্তনের অঙ্গ। তার সঙ্গেই তাল মিলিয়ে ঘরে ঘরে ঢুকে পড়ছে মাদক। এ সব এখন অনেক সহজলভ্য হয়ে গিয়েছে।
তার পরিণতি কতটা ভয়ঙ্কর হচ্ছে, তা টের পাওয়া যাচ্ছে শহরের আনাচ-কানাচে কান পাতলেই। সম্ভ্রান্ত বাড়ির ছেলেমেয়ে বাইরে চুরি করতে গিয়ে ধরা পড়ছেন, কেউ বা বাবা-মাকে মারধর করছেন। এক যুবকের উচ্চবিত্ত মায়ের অভিযোগ, এমন সব ছেলেদের পাল্লায় পড়েছিলেন তাঁর সন্তান, যাঁরা তাঁর ছেলেকে শপিং মল থেকে চুরি করা শিখিয়েছেন। চুরি করতে বাধ্য করেছেন। সে সব থেকে বেরিয়ে আসতে চাইলে অন্ধকার পার্কে নিয়ে গিয়ে তাঁকে বেধড়ক মারধরও করা হয়েছে।
দুর্গাপুর থেকে এ শহরে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়তে এসে সল্টলেকে ফ্ল্যাট ভাড়া নিয়ে একা থাকতেন এক যুবক। নিজেই জানান, একটি ট্যাবলেট খেয়ে নেশা করতে শুরু করেন। সকালে কলেজ যাওয়ার আগে চায়ের সঙ্গে ১০টা ট্যাবলেট আবার সন্ধ্যায় ফ্ল্যাটে ফিরে চায়ের সঙ্গে ১০টা ট্যাবলেট খেতেন।
এ ভাবেই শহরের একটি বড় সংখ্যক প্রতিভাবান ছেলে-মেয়ে নেশার জালে জড়িয়ে পড়ছেন। সেখানে ডাক্তারি ছাত্রেরা যেমন রয়েছেন, তেমনই রয়েছেন সরকারি-বেসরকারি ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের ছাত্রছাত্রীরাও। এঁরা সকলেই উচ্চ-মধ্যবিত্ত বা উচ্চবিত্ত ঘরের সন্তান। দামি মাদকের টাকা জোগাড় করতেও তাঁদের সমস্যা হয় না বিশেষ। শহরের নানা প্রান্তে প্রতি সপ্তাহান্তে কারও কারও বাড়িতেই বসছে এমনই সব নেশার
চিকিৎসকেরা জানাচ্ছেন, এ ভাবে লাগামহীন মাদক সেবনের প্রভাব মারাত্মক হতে পারে। সময়মতো আটকাতে না পারলে, মৃত্যু পর্যন্ত হতে পারে। অনেকে ভাবেন, কম পরিমাণে খেয়ে, পরে বন্ধ করে দেবেন। কিন্তু এ ক্ষেত্রে পুনরায় মাদক নেওয়ার প্রবণতা দেখা দেওয়ার আশঙ্কা থাকে। এমনকি, মাদকের নেশা ছেড়ে দেওয়ার বহু বছর পরেও মস্তিষ্কে তার প্রভাব পড়তে পারে। মস্তিষ্কের সঙ্গে ক্ষতি হতে পারে স্নায়ুরও।
কিন্তু এত মাদক জোগাচ্ছেন কারা?
মাদকাসক্ত তরুণ-তরুণীদের থেকে জানা যাচ্ছে, তাঁরা ইন্টারনেট মারফত দামি মাদক আমদানি করেন। ডার্ক-নেটে বিটকয়েনের মতো মুদ্রা ব্যবহারেরও প্রমাণ পেয়েছে নার্কোটিক্স কন্ট্রোল ব্যুরো (এনসিবি)। চাহিদা বাড়তে দেখে এক দল ব্যবসায়ী কলেজপড়ুয়াদের মারফত মাদক আরও ছড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা করছেন শহরে। মাস কয়েক আগেই মাদক বিক্রি করতে গিয়ে ধরা পড়েছেন এ শহরেরই এক ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের ছাত্র। সল্টলেকের বাসিন্দা, সম্ভ্রান্ত পরিবারের ২২ বছরের এক যুবকও সম্প্রতি গ্রেফতার হয়েছেন মাদক সরবরাহের অভিযোগে। এনসিবি অফিসারেরা জানিয়েছেন, এই কাজে সহজেই বিশাল টাকার মুনাফা পাওয়া যাচ্ছে। এক বার ধরা পড়লে যে ২০ বছর পর্যন্ত সাজা হতে পারে, তা খেয়াল রাখছেন না কেউ।