এত দিন অভিযোগ ছিল এ শহরের এক দল যুবকের বিরুদ্ধে। সিঙ্গাপুর, ব্যাঙ্কক, ঢাকা, দুবাই যাতায়াত করার ফাঁকে নিয়মিত চোরাপাচার করছেন তাঁরা। এ বার অভিযোগ উঠছে একদল যুবতীর বিরুদ্ধেও। কলকাতা থেকে মাদক নিয়ে বিদেশে পাড়ি দিচ্ছেন তাঁরা। ফেরার পথে লুকিয়ে আনছেন সোনা।
সম্প্রতি একবালপুর থানার মোমিনপুর এলাকার পাঁচ যুবক মাদক পাচারের অভিযোগে চিনের কুনমিং বিমানবন্দরে গ্রেফতার হন। ভেষজ ওষুধের কৌটোয় মাদক পাচার করতে গিয়ে ধরা পড়ে গিয়েছিলেন তাঁরা। চিন থেকে বিদেশ মন্ত্রক মারফত খবরটি পৌঁছয় কলকাতা পুলিশের কাছে। এর পরেই গোয়েন্দারা তদন্তে নেমে জানতে পারেন এ শহরের যুবতীরাও এখন নেমে পড়েছেন এই কাজে।
বন্দর এলাকায় চোরাচালানের সঙ্গে যুক্ত এক মাফিয়ার কথায়, ‘‘এক কলেজ পড়ুয়া মেয়ে খুব ভাল কাজ করছে দাদা। এক ট্রিপে (যাতায়াত) দেড় লক্ষ টাকা নিচ্ছে।’’ নাজির বাগানের এক মাদক মাফিয়ার কথায়, ‘‘কলেজ পড়ুয়া কয়েকটি মেয়ে মাসে তিনবার কলকাতা থেকে বিদেশে যাচ্ছেন। যাওয়ার পথে সঙ্গে মাদক নিয়ে যাচ্ছেন। ফেরার পথে বিদেশি পোশাকের সঙ্গে সোনা নিয়ে আসছেন। এ ভাবে কারও মাসে প্রায় সাড়ে চার লক্ষ টাকাও আমদানি হচ্ছে।’’
গোয়েন্দারাও জানাচ্ছেন, এই কাঁচা টাকাই এই ঝুঁকির কাজে টেনে আনছে যুবতীদের। মূলত একবালপুর ও ওয়াটগঞ্জ থানার অধীনে মোমিনপুর রোড, একবালপুর রোড, সুধীর বোস রোড, ডেন্ট মিশন রোড, নাজির লেন, নাপানি বাগান এলাকায় থাকেন এঁরা। কলকাতা পুলিশের এক গোয়েন্দা কর্তার কথায়, এই সব এলাকায় শিক্ষার হার খুব কম। অধিকাংশই স্কুলছুট। ফলে বিমানে বিদেশ যাতায়াত, মাসে কয়েক লক্ষ টাকার এই হাতছানি এড়াতে পারছেন না যুবক-যুবতীর দল।
মোমিনপুর রোডের এক মাদক মাফিয়া জানালেন, মাদক মূলত নেপাল থেকে সড়কপথে এসে পৌঁছয় খিদিরপুরে। তার পরে তা বদলে ফেলা হয় নানা মোড়কে। এর পরেই ওই যুবক-যুবতীরা মাদক পৌঁছে দেন বিদেশে। তাঁরাই যখন আবার দেশে ফিরছেন, তখন তাঁদের হাতে তুলে দেওয়া হচ্ছে পোশাক ও সোনা। তদন্তে নেমে পুলিশ জেনেছে, এই একবালপুর-ওয়াটগঞ্জ এলাকার বেশ কয়েকজন যুবক ভিসা নিয়ে বিদেশে রয়েছেন। তাঁরাও এই পাচারের কাজে সাহায্য করছেন।
কিন্তু বিমানবন্দরের কড়া নিরাপত্তার মধ্যে দিয়ে কী ভাবে মাদক পাচার হচ্ছে? মুচকি হেসে মাদক মাফিয়া বললেন, ‘‘নানা ফন্দি করে চোখ এড়িয়ে মাদক পাচার করা হয়। দেখেছেন তো যে মাস খানেক আগে কলকাতা বিমানবন্দর দিয়ে ভেষজ ওষুধের কৌটো করে মাদক পৌঁছে গিয়েছিল চিন। যাওয়ার সময়ে ধরা পড়েনি।’’ কিছুটা থেমে ওই ব্যক্তি বলেন, ‘‘গত কয়েক বছরে প্রায় কয়েকশো কোটি টাকার সোনা কলকাতা বিমানবন্দর থেকে বেরিয়ে গিয়েছে। ধরা পড়েছে নামমাত্র।’’
কলকাতা বিমানবন্দরের এক শুল্ক অফিসার জানান, গত এক বছরে মূলত ব্যাঙ্কক থেকে পাচার হওয়ার পথে প্রায় ৬০ থেকে ৭০ কোটি টাকার সোনা ধরা পড়ে কলকাতা বিমানবন্দরে। ধৃত অধিকাংশ যাত্রীই এই একবালপুর ও ওয়াটগঞ্জ এলাকার বাসিন্দা। মাফিয়াদের দাবি যদি সত্যি হয়, তা হলে এই ৬০-৭০ কোটি টাকার অনেক বেশি মূল্যের সোনা ধরা না পড়ে সোজা ঢুকে এসেছে কলকাতায়।
বছর পঁচিশ আগেও কলকাতার এই বন্দর এলাকা অপরাধ জগতের নানা গোষ্ঠীদ্বন্দ্বের জন্য খবরের শিরোনামে থাকত। এখন অবশ্য বদলেছে অপরাধের ধরন। ওই এলাকার অলি-গলি এখন ‘স্মাগলিং’-এর আঁতুরঘর বলেই মনে করছেন লালবাজারের পুলিশ কর্তারা।