ভোট-বিধির বজ্র আঁটুনিতে বেহাল সুরক্ষার ফস্কা গেরো

না আছে নিজস্ব বন্দুক, না আছে লাইসেন্স। এমনকী, কত জন বন্দুক চালনার প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত, তা-ও জানেন না পুরকর্তারা। অথচ, তাঁদের হাতে টালা জলাধার, পলতার জল শোধনাগার থেকে শুরু করে পুর-কর আদায় কেন্দ্রের মতো গুরুত্বপূর্ণ জায়গার সুরক্ষার ভার। দীর্ঘ দিন ধরেই চলছে এমন ব্যবস্থা।

Advertisement

অনুপ চট্টোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ১৯ মার্চ ২০১৬ ০২:৪৬
Share:

না আছে নিজস্ব বন্দুক, না আছে লাইসেন্স। এমনকী, কত জন বন্দুক চালনার প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত, তা-ও জানেন না পুরকর্তারা। অথচ, তাঁদের হাতে টালা জলাধার, পলতার জল শোধনাগার থেকে শুরু করে পুর-কর আদায় কেন্দ্রের মতো গুরুত্বপূর্ণ জায়গার সুরক্ষার ভার। দীর্ঘ দিন ধরেই চলছে এমন ব্যবস্থা।

Advertisement

এখন ভোটের মরসুমে এই ঘটনা নজরে এল কর্তৃপক্ষের। পুরসভার এক আধিকারিক জানান, ভোট এলেই বন্দুক থানায় জমা দেওয়ার তোড়জোড় পড়ে সর্বত্র। অস্ত্র আইন অনুসারে, ব্যক্তিগত মালিকানায় থাকা কোনও আগ্নেয়াস্ত্রের লাইসেন্স যে থানা থেকে নেওয়া হয়েছে, ভোটের সময়ে সেই থানায় তা জমা দিতে হয়। কিন্তু পুর-রক্ষীরা অস্ত্র জমা দিলে অরক্ষিত থাকবে পুরসভার বহু গুরুত্বপূর্ণ সম্পত্তি। তাই নিজেদের সব অস্ত্রের ক্ষেত্রে ছাড় চেয়ে পুর-প্রশাসন স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে বিভিন্ন জেলা প্রশাসনের কাছে লিখিত আবেদন জানায়। সেই সব চিঠি করতে গিয়েই দেখা গেল, পুরসভার খাতায় সশস্ত্র বাহিনীর সদস্য হিসেবে পরিচিত বহু কর্মীর নিজের নামে বন্দুকের লাইসেন্সই নেই। অথচ এঁদেরই নিরাপত্তারক্ষী হিসেবে নিয়োগ করে পুরসভা থেকে বছরের পর বছর কমিশন নিয়ে যাচ্ছে একাধিক ঠিকাদার সংস্থা। ওই ‘সশস্ত্র’ নিরাপত্তারক্ষীরাই পুরসভার কয়েকশো কোটি টাকার সম্পত্তি রক্ষার কাজে নিযুক্ত রয়েছেন।

বিষয়টি জানাজানি হতেই নড়ে বসেছেন মেয়র শোভন চট্টোপাধ্যায়ও। তাঁর বক্তব্য, ‘‘বিষয়টি পুরো জানি না। তবে আর্মড ফোর্সের ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট রক্ষীর নিজস্ব বন্দুক ও লাইসেন্স থাকা জরুরি। এর অন্যথা হয়ে থাকলে যে সংস্থা তাদের সরবরাহ করেছে, তাদের জবাবদিহি করতে হবে।’’ যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলেও জানান তিনি।

Advertisement

এক পুরকর্তার কথায়, ‘‘এঁদের অনেকের বন্দুক নিজস্ব নয়। কোনও নিকটাত্মীয়ের নামে। বন্দুকের লাইসেন্স রয়েছে, যে জেলায় তাঁর বাড়ি সেই এলাকায়। যদিও সেটি তিনি ব্যবহারের জন্য বহন করছেন কলকাতা পুরসভার কাজে।’’ ওই অফিসার জানান, অস্ত্র আইন অনুসারে এক জায়গার বন্দুক অন্য জায়গায় ব্যবহার করা যায় না। সে ক্ষেত্রে পলতায় জল শোধনাগার বা টালা ট্যাঙ্কের মতো ‘হাই সিকিওরিটি জোন’-এর সুরক্ষার দায়িত্বে যাঁরা রয়েছেন, আপৎকালীন পরিস্থিতিতে তাঁরাও আইন মাফিক বন্দুক চালাতে পারবেন কি না, তা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন ওই পুরকর্তা।

তবে তাঁদের নিযুক্ত করা হল কেন? পুরসভার যুগ্ম কমিশনারের দফতর সূত্রে খবর, চারটি ঠিকাদার সংস্থা পুরসভায় নিরাপত্তারক্ষী সরবরাহ করে। এখন কলকাতা পুরসভায় প্রায় সাড়ে তিন হাজার নিরাপত্তারক্ষী আছেন। তাঁদের ২৫৬ জন ‘সশস্ত্র’। এর জন্য মাসে পুরসভার সাড়ে ৪ কোটি টাকা খরচ হয়। ওই রক্ষীদের বেতন বাবদ ৪ কোটি এবং কমিশন বাবদ ঠিকাদার সংস্থাকে প্রায় ৫০ লক্ষ টাকা দিতে হয়। পুরসভার এক অফিসার জানান, অস্ত্রহীন নিরাপত্তারক্ষীর বেতন মাসে সাড়ে ৭ হাজার। আর সশস্ত্র রক্ষীর ক্ষেত্রে তা আরও হাজার দেড়েক বেশি। অর্থাৎ, প্রায় ৯ হাজার। আর প্রতি নিরাপত্তারক্ষী সরবরাহের জন্য মাসে ১২৩৮ টাকা কমিশন পায় ঠিকাদার। অভিযোগ, মূলত কমিশনের কথা ভেবেই সব ধরনের রক্ষী সরবরাহ করে থাকে ওই সব সংস্থা।

সশস্ত্র রক্ষী কী ভাবে নিয়োগ করা দরকার? পুরসভার এক সিকিওরিটি অফিসারের কথায়, বেসরকারি সশস্ত্র রক্ষী নিয়োগের ক্ষেত্রে আবেদনকারীর বন্দুক চালানোর প্রশিক্ষণ আছে কি না, তা দেখা জরুরি। মূলত অবসরপ্রাপ্ত সেনা ওই ধরনের কাজের জন্য যোগ্য। দ্বিতীয়ত, তাঁর হাতে অস্ত্র দিতে হবে নিয়োগ-কর্তাকেই। তাতে অস্ত্রের গুণমান নিয়ে স্বচ্ছ ধারণা থাকবে নিয়োগ সংস্থার। এখানে তা হয়নি বলেই জানান পুরসভার একাধিক অফিসার। কেন? পুরসভার খবর, এই ধরনের ক্ষেত্রে কাউন্সিলর, নেতা-নেত্রীদের সুপারিশ ‘বিশেষ’ গুরুত্ব পায়। অন্য মাপকাঠি সেখানে গৌণ। যেমন নিয়োগের শর্তে বলা ছিল, বন্দুক দেখাতে হবে। যা ডিউটির সময়ে সঙ্গে থাকবে। আর সেই সুযোগেই বাবা-কাকার বন্দুক নিয়ে অনেকেই ঢুকে পড়েছেন ‘সশস্ত্র’ রক্ষী হিসেবে।

পুরসভার সার্জেন্ট হিসেবে দীর্ঘ দিন নিরাপত্তার দায়িত্ব পালন করেছেন তৃণমূল নেতা শোভনদেব চট্টোপাধ্যায়। তাঁর বক্তব্য, ‘‘আগে নিরাপত্তার দায়িত্বে ছিলেন স্থায়ী কর্মীরা। এখন চুক্তির ভিত্তিতে বাইরে থেকে রক্ষী নেওয়া হয়। তবে যাঁদের উপযুক্ত প্রশিক্ষণ ও বন্দুকের লাইসেন্স আছে, তাঁদেরই নেওয়া উচিত। এ কথা আমরা বারবার বলেছি।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন